বিশ্ব অর্থনীতিতে মার্কিন ডলারের একচেটিয়া আধিপত্যের দিন কি শেষ হতে চলেছে? ভারত সম্প্রতি BRICS জোটের সদস্য দেশগুলির কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ সার্কুলার জারি করে রুপিতে সরাসরি লেনদেনের অনুমতি দিয়েছে, যা বিশ্ব বাণিজ্যে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। এই সিদ্ধান্ত এসেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারতের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর, যা ভারতীয় রুপির মান জোরদার করার লক্ষ্যে নেওয়া একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শুধু BRICS দেশগুলিই নয়, ভারত অন্যান্য দেশের কাছেও এই সার্কুলার পাঠিয়েছে, যাতে তারা ডলারের পরিবর্তে রুপিতে লেনদেন করতে পারে। এই পদক্ষেপ বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং রুপির আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর একটি স্পষ্ট প্রয়াস।
কেন এই পদক্ষেপ?
মার্কিন ডলার দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ব বাণিজ্যের প্রধান মুদ্রা হিসেবে কাজ করে আসছে। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে BRICS জোট—ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা—ডলারের এই আধিপত্য কমানোর জন্য স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেনের উপর জোর দিচ্ছে। ভারতের এই সার্কুলার এই দিকে একটি বড় পদক্ষেপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক শুল্ক নীতি, বিশেষ করে ভারতের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ, ভারতকে এই পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করেছে। এটিকে হোয়াইট হাউসের নীতির বিরুদ্ধে একটি প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ভারতের এই উদ্যোগ শুধু রুপির মান বাড়ানোর জন্য নয়, বরং বিশ্ব বাণিজ্যে ভারতের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং প্রভাব বৃদ্ধির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
BRICS-এর ভূমিকা ও ভারতের অবস্থান
BRICS জোট ২০২২ ও ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বর্ণ ক্রেতা ছিল এবং ২০২৪ সালেও এই প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। রাশিয়া এবং চীনের মতো দেশগুলি মার্কিন ট্রেজারি বন্ড এবং অন্যান্য ডলার-ভিত্তিক সম্পদ বিক্রি করে স্বর্ণ ক্রয়ে মনোযোগ দিচ্ছে। তবে, ভারতের অবস্থান এখানে কিছুটা ভিন্ন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সংসদে স্পষ্ট করে বলেছেন, ভারত সম্পূর্ণভাবে ডলার ত্যাগ করার পক্ষে নয়। তিনি বলেন, ভারত কেবলমাত্র উপযুক্ত ক্ষেত্রে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেনের পক্ষে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে ভারত একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করছে, যেখানে ডলারের পাশাপাশি রুপির ব্যবহার বাড়ানোর উপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব
ভারতের এই পদক্ষেপের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের চাহিদা কিছুটা হ্রাস পেতে পারে। বিশেষ করে, আন্তঃসীমান্ত লেনদেন রুপিতে হলে ভারতের অর্থনীতি উপকৃত হবে। তবে, এটি একটি চ্যালেঞ্জও। সম্প্রতি ভারতীয় রুপি মার্কিন ডলারের বিপরীতে ৮৭.৬০-এর সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে, যা ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে (আরবিআই) বাজারে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য করেছে। এই পরিস Glossary: De-dollarization – ডি-ডলারাইজেশন: মার্কিন ডলারের উপর নির্ভরতা কমিয়ে স্থানীয় বা অন্য মুদ্রায় লেনদেন বাড়ানোর প্রক্রিয়া।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই উন্নয়নকে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। আগামী মাসে ব্রাজিলের রিও ডি জানেইরোতে অনুষ্ঠিতব্য BRICS সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অংশগ্রহণ ওএইচএস ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। BRICS-এর মুদ্রা আলোচনা এবং ডি-ডলারাইজেশন প্রচেষ্টা মার্কিন আর্থিক আধিপত্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে, ভারতের দ্বৈত নীতি—ডলারের পাশাপাশি রুপির ব্যবহার বাড়ানো—এই উত্তেজনা কিছুটা কমাতে পারে।
ভারতের কৌশল ও ভবিষ্যৎ
ভারতের এই পদক্ষেপ শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন শুল্ক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে এটি ভারতের স্বাধীন অর্থনৈতিক নীতির প্রতিফলন। তবে, ভারত একটি BRICS মুদ্রার প্রস্তাবকে সমর্থন না করে মার্কিন ডলারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করছে। এটি ভারতের কৌশলগত ভারসাম্যের একটি উদাহরণ, যেখানে দেশটি বিশ্ব অর্থনীতিতে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করার পাশাপাশি পশ্চিমা দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইছে।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
রুপিতে লেনদেন বাড়ানোর এই উদ্যোগ সফল হলে ভারতের অর্থনীতি নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে। তবে, রুপির মান স্থিতিশীল রাখা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য ভারতকে আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। BRICS দেশগুলির মধ্যে ঐক্য এবং সহযোগিতাও এই উদ্যোগের সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া ও ইরানের মতো দেশগুলি ইতিমধ্যেই ডি-ডলারাইজেশনের পথে এগিয়ে চলেছে, এবং ভারতের এই পদক্ষেপ তাদের প্রচেষ্টার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে পারে।
ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্ত বিশ্ব বাণিজ্যে রুপির ভূমিকা বাড়ানোর একটি সাহসী পদক্ষেপ। যদিও মার্কিন ডলারের আধিপত্য এখনই শেষ হচ্ছে না, ভারতের এই উদ্যোগ বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি নতুন ভারসাম্য সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এটি কেবল ভারতের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রতীক নয়, বরং BRICS জোটের মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরির একটি প্রয়াস। ভবিষ্যতে এই পদক্ষেপ কতটা সফল হবে, তা সময়ই বলবে।