প্রধান নির্বাচন কমিশনার (CEC) গ্যনেশ কুমার রবিবার স্পষ্ট জানালেন, ভোটার তালিকার ত্রুটি, ডুপ্লিকেট EPIC নম্বর বা ‘হাউস নং ০’-র মতো বিষয়কে কেন্দ্র করে বিভ্রান্তি ছড়ানো বন্ধ করা উচিত। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “ভারতের নির্বাচন কমিশন ভোটারদের সঙ্গে পাথরের মতো দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে এবং থাকবে।”
কুমার জানান, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ডুপ্লিকেট EPIC নম্বরের সমস্যা অতীতে তৈরি হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, একজন ভোটার পশ্চিমবঙ্গে EPIC নম্বর ব্যবহার করছেন, আবার অন্য এক ব্যক্তি হরিয়ানায় একই EPIC নম্বর ব্যবহার করছেন। মার্চ ২০২৫ নাগাদ এই সমস্যা নজরে আসে। তিনি জানান, দেশজুড়ে প্রায় তিন লক্ষ ভোটারের EPIC নম্বর ডুপ্লিকেট ছিল, যাদের নম্বর সংশোধন করা হয়েছে।
তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, অনেক ক্ষেত্রে একই ব্যক্তির নাম একাধিক ভোটার তালিকায় থেকে গিয়েছিল। ২০০৩ সালের আগে প্রযুক্তিগত পরিকাঠামো না থাকায় যারা এক এলাকা থেকে অন্যত্র চলে যেতেন, তাদের নাম পুরোনো তালিকা থেকে মুছে ফেলা সম্ভব হতো না। ফলে একই ভোটারের একাধিক EPIC নম্বর তৈরি হয়েছিল।
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, “যদি দ্রুততার সঙ্গে নাম বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া চালানো হয়, তবে ভুলবশত অনেক প্রকৃত ভোটারের নামও বাদ পড়তে পারে। অন্য কারও নাম মুছে যেতে পারে আপনার নামে।”
সম্প্রতি কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী দাবি করেছিলেন, প্রায় ৮০,০০০ ভোটারের নাম ‘হাউস নং ০’-তে রয়েছে এবং এরা নকল ভোটার। এই অভিযোগকে কড়া ভাষায় খারিজ করেছেন CEC। তিনি বলেন, “প্রত্যেক গ্রাম বা শহরে বাড়ির নম্বর থাকে না। অনেক গরিব মানুষের স্থায়ী বাড়ি নেই। তারা রাস্তায়, সেতুর নিচে বা খোলা জায়গায় রাত কাটান। তাদের ভোটাধিকার অস্বীকার করা যায় না। তাই কমিশন নির্দেশ দেয়, যাদের নির্দিষ্ট বাড়ির নম্বর নেই তাদের ‘নোটশনাল নম্বর’ দেওয়া হবে। কম্পিউটারে তা প্রবেশ করালে ০ দেখা যায়। কিন্তু এর মানে এই নয় যে তারা ভুয়ো ভোটার।”
কুমার আরও বলেন, “দেশের কোটি কোটি বাড়ি এখনও আনুষ্ঠানিক নম্বর পায়নি। শহরের অননুমোদিত কলোনিগুলিরও নম্বর থাকে না। সেক্ষেত্রে ভোটাররা কী লিখবেন? তাই এই প্রক্রিয়া চালু আছে।”
বিরোধীদের উত্থাপিত “ভোট চুরি”র অভিযোগকেও কঠোর ভাষায় প্রত্যাখ্যান করেছেন কুমার। তাঁর কথায়, “এটি ভারতের সংবিধানের অপমান ছাড়া আর কিছুই নয়।”
তিনি উদাহরণ দেন, “বিহারের সাত কোটি ভোটার যখন কমিশনের পাশে দাঁড়ান, তখন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না।” আইন অনুযায়ী নির্বাচনের ৪৫ দিনের মধ্যে যদি কোনও পক্ষ ভোটার তালিকা নিয়ে আপত্তি না তোলে, পরে ‘ভোট চুরি’র মতো শব্দ ব্যবহার করা সংবিধানকে অসম্মান করার সমান।
এছাড়া কংগ্রেসের মেশিন-পঠনযোগ্য ভোটার তালিকার দাবিও তিনি নাকচ করে দেন। তিনি জানান, সুপ্রিম কোর্ট ২০১৯ সালে এই ধরনের তালিকা নিষিদ্ধ করেছে। কমিশনের সিদ্ধান্ত সেই রায়ের ভিত্তিতেই নেওয়া।
কুমার বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ক্ষেত্রে ভোটারদের ছবি ও তথ্য সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়েছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “আমাদের মা-বোনদের ছবি বা ভিডিও কি কমিশনের মাধ্যমে প্রকাশ করা উচিত? ভোটার তালিকায় শুধুমাত্র প্রকৃত ভোটাররাই থাকেন। আর যখন এক কোটি সরকারি কর্মী, দশ লক্ষেরও বেশি বুথ এজেন্ট এবং ২০ লক্ষের বেশি পোলিং এজেন্ট যুক্ত থাকেন, তখন ভোট চুরি হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।”
বর্তমানে বিহারে বিশেষ নিবিড় পুনর্বিবেচনা (Special Intensive Revision – SIR) চলছে। এ প্রসঙ্গে কুমার বলেন, “এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ স্বচ্ছ। এখনও পর্যন্ত ২৮,৩৭০টি দাবি ও আপত্তি জমা পড়েছে। সব রাজনৈতিক দল, ব্লক লেভেল অফিসার এবং বুথ লেভেল এজেন্টরা তা যাচাই করে ভিডিও সাক্ষ্য সহ নথিভুক্ত করছেন। কিন্তু যদি এই সমস্ত যাচাই করা নথি রাজ্য বা জাতীয় নেতৃত্বের কাছে না পৌঁছায় এবং মাটির সত্যিটা উপেক্ষা করে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়, তবে তা উদ্বেগজনক।”
নিজের বক্তব্যের শেষে তিনি স্পষ্ট বার্তা দেন, “যখন ভারতের ভোটারদের নিশানা করে কমিশনের কাঁধে বন্দুক রাখা হয়, তখন কমিশন জানাতে চায়— আমরা সব সময়ই ভোটারদের পাশে ছিলাম, আছি এবং থাকব। দরিদ্র হোক বা ধনী, প্রবীণ হোক বা তরুণ, মহিলা হোক বা পুরুষ— কোনও ভেদাভেদ ছাড়া সবার পাশে দাঁড়াবে নির্বাচন কমিশন।”