পশ্চিমবঙ্গের কৃষি অর্থনীতির মূল ভিত্তি হলো রাজ্যের বিভিন্ন মান্ডি বা কৃষি বাজার (Mandi Prices), যেখানে ধান, পাট এবং আলুর মতো প্রধান ফসলের দাম নির্ধারিত হয়। এই মান্ডিগুলো কৃষকদের জন্য তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। ২০২৫ সালের ১৭ আগস্ট পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের প্রধান মান্ডিগুলোতে ধান, পাট এবং আলুর দামে সামান্য ওঠানামা লক্ষ্য করা গেছে। এই প্রতিবেদনে আমরা রাজ্যের প্রধান মান্ডিগুলোর আজকের ফসলের দাম, এর পেছনের কারণ এবং কৃষকদের উপর এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।
আজকের মান্ডি দাম: ধান, পাট ও আলু
পশ্চিমবঙ্গের কৃষি বাজারে ধান, পাট এবং আলু রাজ্যের প্রধান ফসল হিসেবে বিবেচিত হয়। নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, হাওড়া, এবং বর্ধমানের মতো জেলাগুলোতে অবস্থিত মান্ডিগুলো এই ফসলের দাম নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিম্নে আজকের (১৭ আগস্ট, ২০২৫) মান্ডি দামের একটি
সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হল:
ধান (Paddy): বর্ধমান এবং নদিয়ার মান্ডিতে ধানের দাম প্রতি কুইন্টালে ২,২০০ থেকে ২,৪০০ টাকার মধ্যে রয়েছে। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (MSP) প্রতি কুইন্টালে ২,৩০০ টাকার কাছাকাছি থাকায় কৃষকরা কিছুটা সুবিধা পাচ্ছেন। তবে, বাজারে উৎপাদনের পরিমাণ বেশি হওয়ায় কিছু এলাকায় দাম কিছুটা কম রয়েছে।
পাট (Jute): পাটের এমএসপি সম্প্রতি বাড়িয়ে প্রতি কুইন্টালে ৫,৫০০ টাকা (আনুমানিক) করা হয়েছে। মুর্শিদাবাদ এবং কোচবিহারের মান্ডিতে পাটের দাম ৫,৩০০ থেকে ৫,৬০০ টাকার মধ্যে রয়েছে। তবে, জুট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (JCI)-এর ক্রয় কেন্দ্রে পৌঁছানোর জটিলতার কারণে অনেক কৃষক বাজারে কম দামে পাট বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
আলু (Potato): হাওড়া এবং বাঁকুড়ার মান্ডিতে আলুর দাম প্রতি কুইন্টালে ১,৪০০ থেকে ১,৬০০ টাকার মধ্যে রয়েছে। আলুর উৎপাদন এই মরসুমে তুলনামূলকভাবে ভালো হওয়ায় দামে স্থিতিশীলতা লক্ষ্য করা গেছে। তবে, কোল্ড স্টোরেজের অভাব এবং পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণে কৃষকদের লাভ কমছে।
দামের ওঠানামার কারণ
পশ্চিমবঙ্গের মান্ডিতে ফসলের দাম বিভিন্ন কারণের উপর নির্ভর করে। প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এই মরসুমে ফসলের উৎপাদনের উপর প্রভাব ফেলেছে। এক্স প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বৈশ্বিক আবহাওয়ার অস্থিরতা কৃষি উৎপাদনের উপর প্রভাব ফেলছে, যা পশ্চিমবঙ্গের কৃষি বাজারেও প্রতিফলিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং খরার কারণে পাট এবং ধানের উৎপাদন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা দামের ওঠানামার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দ্বিতীয়ত, সরকারি নীতি এবং এমএসপি বৃদ্ধি মান্ডি দামের উপর প্রভাব ফেলছে। পাটের এমএসপি বৃদ্ধি কৃষকদের জন্য সুবিধা এনেছে, তবে JCI-এর ক্রয় কেন্দ্রের সীমিত সংখ্যা এবং প্রক্রিয়াগত জটিলতা কৃষকদের পূর্ণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করছে। আলুর ক্ষেত্রে, কোল্ড স্টোরেজের অভাব এবং পরিবহন খরচ বৃদ্ধি কৃষকদের লাভের পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে।
তৃতীয়ত, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে কৃষি পণ্যের চাহিদা দাম নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পাটের ক্ষেত্রে, পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে এর চাহিদা বাড়ছে, যা দাম বৃদ্ধির একটি কারণ। ধান এবং আলুর ক্ষেত্রে, স্থানীয় চাহিদা এবং রপ্তানি বাজারের প্রভাব দামের স্থিতিশীলতার উপর প্রভাব ফেলছে।
কৃষকদের উপর প্রভাব
পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য মান্ডি দাম তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। ধানের দাম এমএসপির কাছাকাছি থাকায় কৃষকরা কিছুটা সুবিধা পাচ্ছেন, তবে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে তাদের লাভের পরিমাণ সীমিত। পাটচাষীদের জন্য এমএসপি বৃদ্ধি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, তবে JCI-এর ক্রয় কেন্দ্রে পৌঁছানোর অসুবিধা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব তাদের লাভ কমিয়ে দিচ্ছে। আলু চাষীদের ক্ষেত্রে, কোল্ড স্টোরেজের অভাব এবং পরিবহন খরচ তাদের আয়ের উপর চাপ সৃষ্টি করছে।
সমাধানের পথ
মান্ডি দামের স্থিতিশীলতা এবং কৃষকদের সুবিধা নিশ্চিত করতে সরকার এবং সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রথমত, JCI-এর ক্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো এবং ক্রয় প্রক্রিয়া সহজ করা উচিত। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কৃষকদের পাট বিক্রির সুযোগ প্রদান করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, কোল্ড স্টোরেজ এবং পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি আলু চাষীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয়ত, কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো উৎপাদনশীলতা এবং লাভ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
পশ্চিমবঙ্গের মান্ডিগুলোতে ধান, পাট এবং আলুর দাম কৃষকদের জীবনযাত্রার মান এবং রাজ্যের অর্থনীতির উপর গভীর প্রভাব ফেলে। এমএসপি বৃদ্ধি এবং বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি কৃষকদের জন্য ইতিবাচক হলেও, অবকাঠামোগত সমস্যা এবং প্রক্রিয়াগত জটিলতা তাদের পূর্ণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করছে। সরকার, JCI, এবং স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা গেলে, পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা তাদের ফসলের ন্যায্য মূল্য পেতে পারবেন। এই পদক্ষেপগুলো রাজ্যের কৃষি অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে এবং কৃষকদের জীবনমান উন্নত করবে।