দার্জিলিং-এর চা (Darjeeling Tea) বাগান যা বিশ্বব্যাপী ‘চায়ের শ্যাম্পেন’ হিসেবে খ্যাত৷ বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গভীর সংকটের মুখোমুখি। এই অঞ্চলের অনন্য জলবায়ু এবং উর্বর মাটি দার্জিলিং চায়ের স্বতন্ত্র স্বাদ এবং গন্ধের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং মাটির ক্ষয়ের কারণে চা উৎপাদন ও গুণমান ক্রমশ কমছে। এই পরিবর্তন শুধু চা শিল্পের উপরই প্রভাব ফেলছে না, বরং হাজার হাজার চা শ্রমিকের জীবিকা এবং রাজ্যের অর্থনীতির উপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এই প্রতিবেদনে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দার্জিলিং চা শিল্পের সামনে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ এবং এর সমাধানের সম্ভাবনাগুলো নিয়ে আলোচনা করব।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
দার্জিলিং-এর চা বাগানগুলো ঐতিহ্যগতভাবে চারটি ফ্লাশ বা ফসলের মাধ্যমে চা উৎপাদন করে, যার প্রতিটির নিজস্ব স্বাদ ও গন্ধ রয়েছে। প্রথম ফ্লাশ (ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল) তার ফুলের সুবাসের জন্য বিখ্যাত, যা প্রিমিয়াম দামে বিক্রি হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই ফ্লাশগুলো মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। ২০২৩ সালে, প্রথম ফ্লাশের সময় বৃষ্টির অভাবে চা গাছগুলো ‘বানজি’ অবস্থায় চলে গেছে, যেখানে পাতার পরিবর্তে বড় এবং স্বাদহীন পাতা উৎপন্ন হয়েছে। এই সমস্যা উৎপাদন ও গুণমান উভয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
দ্বিতীয় ফ্লাশ (মে-জুন), যা তার মাস্কাটেল স্বাদের জন্য পরিচিত, অকাল মৌসুমি বৃষ্টির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার অভাব শরৎ ফ্লাশকেও প্রভাবিত করছে, যার ফলে পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়েছে। জৈব চা বাগানগুলো কিছুটা প্রতিরোধী হলেও, রাসায়নিক ব্যবহারকারী বাগানগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কারণ কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার পোকামাকড়ের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াচ্ছে।
দার্জিলিং-এর তাপমাত্রা গত কয়েক দশকে ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে, বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১৫২.৫ সেন্টিমিটার কমেছে এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা ১৬% কমেছে। এই পরিবর্তনগুলো চা গাছের জন্য প্রয়োজনীয় জলবায়ু ভারসাম্য নষ্ট করছে। এছাড়া, ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে মাটির ক্ষয় এবং পুষ্টির ক্ষতি চা গাছের স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
শ্রমিকদের উপর প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তন শুধু চা উৎপাদনই নয়, চা শ্রমিকদের জীবনযাত্রার উপরও প্রভাব ফেলছে। দার্জিলিং-এর চা বাগানে প্রায় ৫৫,০০০ স্থায়ী এবং ১৫,০০০ অস্থায়ী শ্রমিক কাজ করেন। কিন্তু, উৎপাদন কমার কারণে তাদের আয় কমছে। শ্রমিকরা দৈনিক ২৫০ টাকা মজুরি পান, যা সরকারি ন্যূনতম মজুরির চেয়ে কম। এছাড়া, অতিরিক্ত গরম এবং কীটনাশকের ব্যবহার শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। অনেক শ্রমিক শ্বাসকষ্ট, ত্বকের সমস্যা এবং অন্যান্য রোগে ভুগছেন।
মহিলা শ্রমিকরা বিশেষভাবে ঝুঁকির মুখে। তারা প্রায় নয় মাস ধরে চা পাতা সংগ্রহ করেন এবং তীব্র গরমে কাজ করার ফলে তাদের স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া, বাগানে ছায়ার অভাব এবং ক্রেচ সুবিধার অভাব তাদের কাজকে আরও কঠিন করে তুলেছে। শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে, এবং অনেকে ভালো মজুরির জন্য শহরে চলে যাচ্ছেন।
অর্থনৈতিক প্রভাব
দার্জিলিং চা শিল্পের উৎপাদন গত দশকে ১২ মিলিয়ন কেজি থেকে ৬ মিলিয়ন কেজিতে নেমে এসেছে। এই কম উৎপাদন এবং গুণমানের অবনতির কারণে রপ্তানি বাজারে চাহিদা কমছে। ইউরোপ এবং জাপানের মতো প্রধান বাজারগুলোতে দার্জিলিং চায়ের দাম কমে যাচ্ছে, যা শিল্পের আয়ের উপর প্রভাব ফেলছে। এছাড়া, নেপালের সস্তা চায়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা এই সংকটকে আরও তীব্র করছে।
সমাধানের পথ
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় দার্জিলিং-এর চা বাগানগুলো বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। জৈব চাষ, মালচিং, এবং ছায়া গাছ রোপণের মতো পদ্ধতি মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা এবং জল ধরে রাখতে সহায়ক হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, আম্বুটিয়া গ্রুপের মতো বড় চা বাগান জৈব চাষে রূপান্তরিত হয়েছে, যা মাটির উর্বরতা বাড়াচ্ছে এবং রাসায়নিক ব্যবহার কমাচ্ছে। এছাড়া, মাকাইবাড়ি চা বাগান মালচিং এবং আন্তঃফসল চাষের মাধ্যমে মাটির ক্ষয় রোধ করছে।
ছায়া গাছ রোপণ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ব্রিটিশ আমলে ছায়া গাছ রোপণ করা হতো, যা চা গাছকে অতিরিক্ত তাপ এবং পোকামাকড় থেকে রক্ষা করত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই গাছ কেটে ফেলা হয়, যা বাগানগুলোকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। বর্তমানে, গুডরিক গ্রুপের মতো কিছু বাগান পুনরায় ছায়া গাছ রোপণ করছে। এছাড়া, জল সংরক্ষণের জন্য ড্রিপ সেচ ব্যবস্থা এবং বৃষ্টির জল সংগ্রহের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
সরকার এবং চা বোর্ডের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। চা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো জলবায়ু-প্রতিরোধী চা গাছের জাত উন্নয়নের জন্য কাজ করছে। তবে, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করার জন্য আরও পদক্ষেপ প্রয়োজন। বাগান মালিকরা মনে করেন, সরকারের আর্থিক সহায়তা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন এই শিল্পকে বাঁচাতে পারে।
দার্জিলিং-এর চা শিল্প জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং মাটির ক্ষয় চা উৎপাদন এবং গুণমানের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এই সংকট শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিকও, কারণ হাজার হাজার শ্রমিকের জীবিকা ঝুঁকির মুখে। জৈব চাষ, ছায়া গাছ রোপণ, এবং উন্নত সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। তবে, এর জন্য সরকার, বাগান মালিক এবং শ্রমিকদের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। দার্জিলিং চায়ের ঐতিহ্য এবং এর সঙ্গে জড়িত জীবিকা রক্ষার জন্য এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।