বাংলায় পোস্ট-প্যান্ডেমিক বাজারে উচ্চ চাহিদায় গাঁদা ফুলচাষে নতুন গতি

পশ্চিমবঙ্গের ফুলচাষ, বিশেষ করে গাঁদা ফুলের চাষ (West Bengal Marigold) সাম্প্রতিক সময়ে একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। পোস্ট-প্যান্ডেমিক বাজারে গাঁদা ফুলের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় রাজ্যের…

West Bengal Marigold Boom: High Demand Fuels Horticulture Growth in Post-Pandemic Market

পশ্চিমবঙ্গের ফুলচাষ, বিশেষ করে গাঁদা ফুলের চাষ (West Bengal Marigold) সাম্প্রতিক সময়ে একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। পোস্ট-প্যান্ডেমিক বাজারে গাঁদা ফুলের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় রাজ্যের ফুলচাষীরা উৎসাহিত। গাঁদা ফুল, যা ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সামাজিক উৎসব এবং সাজসজ্জার জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়, এখন পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জাতীয় উদ্যান বোর্ড (NHB) এবং অন্যান্য সূত্র অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের ফুলচাষ শিল্প, বিশেষ করে গাঁদা ফুলের উৎপাদন, দেশের ফুলের বাজারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। এই প্রতিবেদনে আমরা জানব, কীভাবে গাঁদা ফুলের চাষ পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে নতুন গতি এনেছে এবং পোস্ট-প্যান্ডেমিক বাজারে এর চাহিদা বৃদ্ধির কারণ কী।

গাঁদা ফুলের চাহিদা বৃদ্ধির পেছনে
গাঁদা ফুল ভারতের সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। দুর্গাপূজা, দীপাবলি, বিবাহ এবং অন্যান্য সামাজিক উৎসবের সময় গাঁদা ফুলের চাহিদা তুঙ্গে থাকে। পোস্ট-প্যান্ডেমিক সময়ে, যখন সামাজিক ও ধর্মীয় সমাবেশ আবার জোরদার হয়েছে, তখন গাঁদা ফুলের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এছাড়া, ফুলের রপ্তানি বাজারেও গাঁদা ফুলের চাহিদা বাড়ছে, বিশেষ করে প্রাকৃতিক রঙ এবং ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে এর ব্যবহারের কারণে।

   

জাতীয় উদ্যান বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের ফুল উৎপাদনের প্রায় ৭৫% শুধুমাত্র দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলো যেমন তামিলনাড়ু এবং কর্নাটক থেকে আসে। তবে, পশ্চিমবঙ্গের গাঁদা ফুলের চাষ ধীরে ধীরে এই তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করছে। রাজ্যের নদিয়া, হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো জেলাগুলো গাঁদা ফুলের উৎপাদনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এই অঞ্চলগুলোর উর্বর মাটি, আর্দ্র জলবায়ু এবং পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত গাঁদা ফুলের চাষের জন্য আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করে।

পোস্ট-প্যান্ডেমিক বাজারে গাঁদা ফুলের উত্থান
কোভিড-১৯ মহামারীর পরে, ভারতের ফুলের বাজারে একটি বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। মহামারীর সময় ফুলের চাহিদা কমে গেলেও, ২০২২ সাল থেকে সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পুনরুজ্জীবনের ফলে গাঁদা ফুলের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে, দুর্গাপূজা এবং অন্যান্য উৎসবের সময় গাঁদা ফুলের ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া, গাঁদা ফুলের পাপড়ি থেকে প্রাকৃতিক রঙ (ক্যারোটিনয়েড) উৎপাদনের জন্য ফার্মাসিউটিক্যাল এবং খাদ্য শিল্পে এর চাহিদা বেড়েছে। এই রঙগুলো মুরগির খাদ্যে যোগ করা হয় ডিমের কুসুমের রঙ উন্নত করার জন্য, যা বাজারে একটি অতিরিক্ত সুবিধা এনেছে।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, পশ্চিমবঙ্গের গাঁদা ফুলের চাহিদা শুধুমাত্র স্থানীয় বাজারেই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে গাঁদা ফুলের রপ্তানি বাড়ছে। এই বৃদ্ধির পেছনে সরকারি উদ্যোগ এবং ফুলচাষীদের প্রযুক্তিগত উন্নতিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে গাঁদা ফুলের অবদান
পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে ফুলচাষ, বিশেষ করে গাঁদা ফুলের চাষ, একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ফুলচাষের স্বল্প গেস্টেশন পিরিয়ড এবং উচ্চ আয়ের সম্ভাবনা এটিকে কৃষকদের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলেছে। গাঁদা ফুলের চাষে প্রতি হেক্টরে উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে কম, এবং এটি বছরে একাধিক ফসল উৎপাদনের সুযোগ দেয়। এই কারণে, ছোট এবং মাঝারি কৃষকরা এই চাষের দিকে ঝুঁকছেন।

পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর এবং হাওড়ার উলুবেড়িয়া এলাকা গাঁদা ফুলের উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এই অঞ্চলগুলোতে ফুলচাষীরা আধুনিক কৌশল, যেমন ড্রিপ সেচ ব্যবস্থা এবং জৈব সারের ব্যবহার, গ্রহণ করছেন। এছাড়া, সরকারি প্রণোদনা এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সহায়তায় কৃষকরা উন্নত জাতের গাঁদা ফুলের বীজ ব্যবহার করছেন, যা উৎপাদন বাড়িয়েছে।

Advertisements

ফুলচাষ গ্রামীণ অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে মহিলারা ফুলচাষে ব্যাপকভাবে অংশ নিচ্ছেন। নদিয়া এবং হাওড়ার মতো এলাকায় মহিলা কৃষকরা গাঁদা ফুলের চাষ এবং বিপণনের কাজে নিযুক্ত রয়েছেন। এটি গ্রামীণ নারীদের আর্থিক স্বাধীনতা এবং সামাজিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
গাঁদা ফুলের চাষে পশ্চিমবঙ্গের সাফল্য সত্ত্বেও, এই খাতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, ফুলচাষের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, যেমন কোল্ড স্টোরেজ এবং পরিবহন ব্যবস্থা, এখনও অনেক এলাকায় পর্যাপ্ত নয়। ফুল দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়ায়, সঠিক সংরক্ষণ এবং পরিবহন ব্যবস্থার অভাবে কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়েন। দ্বিতীয়ত, ফুলের বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কৃষকদের লাভের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। তৃতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিরিক্ত বৃষ্টি বা খরা ফুলচাষের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। জাতীয় উদ্যান বোর্ড এবং রাজ্য সরকার ফুলচাষীদের জন্য সহজ ঋণ এবং ভর্তুকি প্রদান করছে। এছাড়া, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাধ্যমে কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে, যাতে তারা আধুনিক চাষ পদ্ধতি এবং প্রযুক্তি গ্রহণ করতে পারে। কোল্ড স্টোরেজ এবং পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি এবং ফুলের নিলাম কেন্দ্র স্থাপন পশ্চিমবঙ্গের ফুলচাষ শিল্পকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
পশ্চিমবঙ্গের গাঁদা ফুলের চাষ ভবিষ্যতে আরও সম্ভাবনাময় হয়ে উঠতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে ফুলের রপ্তানি বাড়ানোর জন্য রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এছাড়া, ডিজিটাল ফ্লাওয়ার অকশন সেন্টারের মতো উদ্যোগ পশ্চিমবঙ্গে চালু করা গেলে কৃষকরা সরাসরি বাজারের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন, যা তাদের লাভ বাড়াবে।
এছাড়া, গাঁদা ফুলের মূল্য সংযোজন পণ্য, যেমন প্রাকৃতিক রঙ, অপরিহার্য তেল এবং শুকনো ফুলের উৎপাদন, আরও বাড়ানো যেতে পারে। এই পণ্যগুলোর চাহিদা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমশ বাড়ছে। পশ্চিমবঙ্গের ফুলচাষীরা যদি এই সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারেন, তবে রাজ্যের অর্থনীতিতে ফুলচাষ একটি প্রধান খাত হয়ে উঠতে পারে।

পশ্চিমবঙ্গের গাঁদা ফুলের চাষ পোস্ট-প্যান্ডেমিক বাজারে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। উচ্চ চাহিদা, সরকারি সহায়তা এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে এই খাত রাজ্যের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তবে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই শিল্পকে আরও শক্তিশালী করা সম্ভব। গাঁদা ফুলের চাষ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সুবিধাই নয়, গ্রামীণ কর্মসংস্থান এবং নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পশ্চিমবঙ্গ এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ফুলচাষের মাধ্যমে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে নিজের অবস্থান মজবুত করতে পারে।