ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের বেতন কাঠামো এবং সুযোগ-সুবিধার উন্নয়নের জন্য বেতন কমিশন (Pay Commissions) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। ১৯৪৬ সালে প্রথম বেতন কমিশন গঠনের পর থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত মোট আটটি বেতন কমিশন গঠিত হয়েছে, যা সরকারি কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারে অবদান রেখেছে। এই প্রতিবেদনে আমরা ভারতের বেতন কমিশনের ইতিহাস, এর বিবর্তন এবং উল্লেখযোগ্য সংস্কারগুলো নিয়ে আলোচনা করব।
প্রথম বেতন কমিশন (১৯৪৬-১৯৪৭)
ভারতের স্বাধীনতার ঠিক আগে, ১৯৪৬ সালে প্রথম বেতন কমিশন গঠিত হয় শ্রীনিবাস বর্ধনের নেতৃত্বে। এই কমিশনের প্রধান লক্ষ্য ছিল সরকারি কর্মচারীদের বেতন কাঠামোকে সুসংগঠিত করা এবং স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা। এই কমিশন প্রথমবারের মতো সরকারি কর্মচারীদের জন্য ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করে, যা ছিল মাসে ৫৫ টাকা। এছাড়া, মহার্ঘ ভাতা (Dearness Allowance) প্রবর্তন করা হয়, যা মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে সহায়ক ছিল। তবে, এই কমিশনের সুপারিশগুলো সীমিত ছিল, কারণ দেশ তখন স্বাধীনতার প্রাক্কালে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।
দ্বিতীয় বেতন কমিশন (১৯৫৭-১৯৫৯)
দ্বিতীয় বেতন কমিশন গঠিত হয় ১৯৫৭ সালে, জগন্নাথ দাসের নেতৃত্বে। এই কমিশনের ফোকাস ছিল সরকারি কর্মচারীদের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেতন সংস্কার। এই কমিশন ন্যূনতম বেতন ৮০ টাকায় উন্নীত করে এবং পেনশন কাঠামোর উন্নতি ঘটায়। এছাড়া, বিভিন্ন স্তরের কর্মচারীদের জন্য বেতন স্কেলের শ্রেণিবিন্যাস আরও সুসংগঠিত করা হয়।
তৃতীয় বেতন কমিশন (১৯৭০-১৯৭৩)
১৯৭০ সালে রঘুবীর দয়ালের নেতৃত্বে তৃতীয় বেতন কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশন প্রথমবারের মতো সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি অভিন্ন বেতন কাঠামো প্রবর্তন করে, যা বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। ন্যূনতম বেতন ১৯৬ টাকায় উন্নীত হয়, এবং মহার্ঘ ভাতার সঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের জন্য আবাসন ও চিকিৎসা সুবিধার উন্নতি ঘটে।
চতুর্থ বেতন কমিশন (১৯৮৩-১৯৮৬)
পি.এন. সিংহের নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালে গঠিত চতুর্থ বেতন কমিশন সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মপরিবেশের উন্নতির উপর জোর দেয়। এই কমিশন ন্যূনতম বেতন ৭৫০ টাকায় উন্নীত করে এবং সরকারি কর্মচারীদের জন্য পেনশন ও গ্র্যাচুইটির পরিমাণ বাড়ায়। এছাড়া, কর্মচারীদের জন্য ছুটির নীতি এবং স্বাস্থ্য সুবিধার উন্নতি ঘটে।
পঞ্চম বেতন কমিশন (১৯৯৪-১৯৯৭)
১৯৯৪ সালে পঞ্চম বেতন কমিশন গঠিত হয় জাস্টিস এস. রত্নাভেল পণ্ডিয়ানের নেতৃত্বে। এই কমিশন সরকারি কর্মচারীদের বেতন কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। ন্যূনতম বেতন ২,৫৫০ টাকায় উন্নীত হয়, এবং মহার্ঘ ভাতার সূত্রে পরিবর্তন আনা হয়। এই কমিশন প্রথমবারের মতো সরকারি কর্মচারীদের জন্য পে-ব্যান্ড সিস্টেম প্রবর্তনের ভিত্তি তৈরি করে।
ষষ্ঠ বেতন কমিশন (২০০৬-২০০৮)
জাস্টিস বি.এন. শ্রীকৃষ্ণের নেতৃত্বে ২০০৬ সালে গঠিত ষষ্ঠ বেতন কমিশন ভারতের সরকারি কর্মচারীদের বেতন কাঠামোতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। এই কমিশন চারটি পে-ব্যান্ড এবং গ্রেড পে সিস্টেম প্রবর্তন করে, যা কর্মচারীদের বেতন নির্ধারণে আরও স্বচ্ছতা এনেছে। ন্যূনতম বেতন ৭,০০০ টাকায় উন্নীত হয়, এবং মহার্ঘ ভাতা, হাউস রেন্ট অ্যালাউন্স (HRA), এবং ট্রান্সপোর্ট অ্যালাউন্সের পরিমাণ বাড়ানো হয়। এই কমিশনের সুপারিশে সরকারি কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়।
সপ্তম বেতন কমিশন (২০১৪-২০১৬)
জাস্টিস অশোক কুমার মাথুরের নেতৃত্বে ২০১৪ সালে গঠিত সপ্তম বেতন কমিশন সরকারি কর্মচারীদের বেতন এবং ভাতায় ২৩.৫৫% বৃদ্ধির সুপারিশ করে। ন্যূনতম বেতন ১৮,০০০ টাকায় উন্নীত হয়, এবং পে-ম্যাট্রিক্স সিস্টেম প্রবর্তিত হয়। এই কমিশন পেনশন সংস্কারের উপরও বিশেষ জোর দেয় এবং গ্র্যাচুইটির সীমা ১০ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে ২০ লক্ষ টাকা করে। এছাড়া, সরকারি কর্মচারীদের জন্য স্বাস্থ্য বীমা এবং অন্যান্য সুবিধার উন্নতি ঘটে।
অষ্টম বেতন কমিশন: প্রত্যাশা ও সম্ভাবনা
২০২৫ সালে অষ্টম বেতন কমিশন গঠনের দাবি উঠেছে। সরকারি কর্মচারী সংগঠনগুলো মনে করছে, মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে নতুন বেতন কমিশন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, অষ্টম বেতন কমিশন ন্যূনতম বেতন ২৬,০০০ টাকায় উন্নীত করতে পারে এবং মহার্ঘ ভাতার হার ৫০% পর্যন্ত বাড়তে পারে। এছাড়া, পেনশন এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি-নির্ভর প্রশাসনিক সংস্কারের উপরও জোর দেওয়া হতে পারে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
বেতন কমিশনগুলো শুধুমাত্র সরকারি কর্মচারীদের জন্যই নয়, অর্থনীতির উপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বেতন বৃদ্ধি ভোক্তা ব্যয় বাড়ায়, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক। তবে, এটি সরকারের আর্থিক বোঝাও বাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের বার্ষিক ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছিল প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা।
পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলোতেও বেতন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়, যা রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের জন্য উল্লেখযোগ্য সুবিধা নিয়ে আসে। তবে, রাজ্য সরকারের আর্থিক সংকটের কারণে কখনও কখনও এই সুপারিশ বাস্তবায়নে দেরি হয়।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ
বেতন কমিশনগুলোর মুখোমুখি প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো আর্থিক বোঝা এবং সরকারি কর্মচারীদের প্রত্যাশার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। এছাড়া, বেসরকারি খাতের সঙ্গে তুলনা করলে সরকারি কর্মচারীদের বেতন কাঠামো কখনও কখনও প্রতিযোগিতামূলক মনে হয় না। অষ্টম বেতন কমিশনের ক্ষেত্রে সরকারকে এই বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে।
প্রথম থেকে সপ্তম বেতন কমিশন পর্যন্ত ভারতের বেতন কমিশনগুলো সরকারি কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার পাশাপাশি প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়িয়েছে। অষ্টম বেতন কমিশনের প্রত্যাশায় সরকারি কর্মচারীরা মুখিয়ে রয়েছেন। সঠিক পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই কমিশন ভারতের অর্থনীতি এবং প্রশাসনিক কাঠামোতে নতুন গতি আনতে পারে।