বাংলাদেশের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস (Muhammad Yunus) সম্প্রতি চাল আমদানি সংক্রান্ত নয়া শুল্কনীতি (Rice Import Policy) ঘোষণা করেছেন, যা সরাসরি ভারতের বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের কৃষি-বাণিজ্য খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এই নীতি অনুসারে বাংলাদেশের বাজারে চালের শুল্কহার কমানো হয়েছে, যাতে দ্রুত আমদানি করা যায় এবং অভ্যন্তরীণ ঘাটতি পূরণ হয়। ফলস্বরূপ, গত কয়েকদিনে ভারতীয় চালের বাজারে দাম এক ধাক্কায় ১৪ শতাংশ বেড়েছে। কৃষি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে এবং ভারতীয় রফতানিকারকদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করেছে।
বাংলাদেশের চাল আমদানি পরিকল্পনা
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ভারী বর্ষণে আমন ধানের ফসল ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দেশটি প্রায় ৯ লক্ষ টন চাল আমদানির ঘোষণা দিয়েছে—এর মধ্যে ৪ লক্ষ টন সরকারি টেন্ডারের মাধ্যমে এবং বাকি ৫ লক্ষ টন বেসরকারি উদ্যোগে আসবে। ভারতের ভৌগোলিক নৈকট্য, পর্যাপ্ত মজুত এবং প্রতিযোগিতামূলক দামের কারণে এই চালের বড় অংশ ভারত থেকেই রফতানি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রাইসভিলা ফুডসের সিইও সুরজ আগরওয়াল বলেন, “বাংলাদেশের এই চাহিদা ভারতের জন্য বিশাল রফতানি সুযোগ। পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং বিহারের মিলগুলো বিশেষভাবে লাভবান হবে। কেবল পশ্চিমবঙ্গ থেকেই বাংলাদেশের বেসরকারি আমদানির ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ সরবরাহ হবে।”
মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব
- আমদানির এই ঘোষণা ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারেও তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া এনেছে।
- ‘স্বর্ণ মনসুরি’ পারবোইল্ড চালের দাম ২৯ টাকা থেকে বেড়ে ৩১–৩২ টাকা প্রতি কেজি হয়েছে।
- জনপ্রিয় ‘মিনিকেট’ চালের দাম ৪১–৪২ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫ টাকা প্রতি কেজি হতে পারে।
- পশ্চিমবঙ্গ ও দক্ষিণ ভারতের বাজারে জনপ্রিয় ‘স্বর্ণা’, ‘রত্না’, ‘সোনা মসুরি’ প্রজাতির দামও দ্রুত বাড়ছে। এর ফলে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা যেমন উপকৃত হবেন, তেমন সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ বাড়বে।
বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি
বাংলাদেশ সরকার ‘খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি’র আওতায় ৫৫ লক্ষ পরিবারকে প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাল ১৫ টাকা কেজি দরে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে এই বিতরণ চলবে। ইতিমধ্যেই ৩.৭৬ লক্ষ টন বোরো ধান ও ৯.৫০ লক্ষ টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে, যদিও লক্ষ্য ছিল ১৪ লক্ষ টন। ঘাটতি পূরণে ভারতের রফতানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে।
ভারতের রফতানি নীতি ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
ভারত বিশ্বের বৃহত্তম চাল রফতানিকারক দেশগুলির একটি। তবে অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য গত বছর চাল, গম ও চিনির রফতানিতে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। তবুও ২০২৩–২৪ অর্থবছরে কৃষি রফতানি ৫৩ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে। বাংলাদেশের নতুন চাহিদা সেই রফতানি প্রবাহে নতুন গতি আনবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের বাড়তি সুযোগ
পশ্চিমবঙ্গের মিলগুলো এই পরিস্থিতিতে বড় সুবিধাভোগী হতে চলেছে। জয় বাবা বাক্রেশ্বর রাইস মিলের ডিরেক্টর রাহুল আগরওয়াল বলেন, “আমরা সরকারি টেন্ডারের পাশাপাশি বেসরকারি অর্ডারেও বড় পরিমাণ চাল সরবরাহ করব। এতে রাজ্যের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন এবং স্থানীয় অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
চ্যালেঞ্জ ও কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট
যদিও পরিস্থিতি অনুকূল, কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে—
- রফতানি নীতি পরিবর্তন: বাসমতি চালের ন্যূনতম রফতানি মূল্য (MEP) পরিবর্তিত হলে বাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে।
- অভ্যন্তরীণ বাজারের চাপ: দাম অতিরিক্ত বাড়তে থাকলে সরকার রফতানিতে নতুন নিয়ন্ত্রণ আনতে পারে।
- কূটনৈতিক টানাপোড়েন: পেট্রাপোল সীমান্তে পোশাক ও পাটপণ্য আমদানিতে ভারতের বিধিনিষেধ দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
তবে রফতানিকারকদের মতে, এই বাধাগুলি খুব বড় প্রভাব ফেলবে না। বিশাখাপত্তনম ও পারাদ্বীপ বন্দরের মতো বড় রফতানি রুটগুলো দ্রুত ডেলিভারি নিশ্চিত করছে।
ইউনুসের নয়া শুল্কনীতি বাংলাদেশের জন্য যেমন খাদ্য ঘাটতি মেটাতে সহায়ক হবে, তেমনই ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের, কৃষি-বাণিজ্য খাতের জন্য বড় আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। দাম বৃদ্ধিতে কৃষক ও রফতানিকারকরা মুনাফা পাবেন, তবে সাধারণ মানুষের খাদ্য ব্যয় বেড়ে যাওয়া একটি বাস্তব চ্যালেঞ্জ। এখন ভারতের করণীয় হবে—রফতানির সুযোগ কাজে লাগানো এবং একইসঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। সঠিক কৃষি পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে এই সুযোগকে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই করা গেলে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের পূর্বাঞ্চল ভবিষ্যতে আরও বড় অর্থনৈতিক সুবিধা পেতে পারে।