রাজ্যে ডিমের ঘাটতি মেটাতে মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে অন্ধ্রপ্রদেশের সাই শিবম পোল্ট্রি ফার্ম জলপাইগুড়ির (Jalpaiguri) রাজগঞ্জ ব্লকের সন্ন্যাসীকাটা গ্রামপঞ্চায়েতের চেকরমারি গ্রামে স্থাপন করেছিল একটি আধুনিক পোল্ট্রি ফার্ম। প্রায় ১৫ একর জমির উপর দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রকল্পে বিনিয়োগ হয়েছে ৪০ কোটি টাকারও বেশি। প্রায় দুই শতাধিক স্থানীয় মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছিলেন এখানে। প্রতিদিন গড়ে এক লক্ষেরও বেশি ডিম উৎপাদন করে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করা হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎই প্রশাসনের নির্দেশে বন্ধ হতে চলেছে এই বৃহৎ ফার্ম। ফলে শ্রমিক থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী মহল— সকলেরই কপালে চিন্তার ভাঁজ।
গ্রামবাসীর অভিযোগেই বন্ধের নির্দেশ
গত কয়েক মাস ধরে অভিযোগ উঠেছে, ফার্ম থেকে মাছির উপদ্রব ছড়িয়ে পড়েছে আটটি গ্রামে। এতে নোংরামি ও অসুবিধা বাড়ার পাশাপাশি মানুষের স্বাস্থ্যও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে এলাকায় এক হাজারেরও বেশি মানুষ জন্ডিসে আক্রান্ত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, লেপ্টোস্পাইরোসিস রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এই রোগ মূলত ইঁদুরের মাধ্যমে ছড়ালেও স্থানীয়দের দাবি, ফার্মের অব্যবস্থাপনার কারণেই রোগ ছড়াচ্ছে। আক্রান্তের সংখ্যা ইতিমধ্যেই একশো পেরিয়েছে। ফলে আতঙ্ক ছড়িয়েছে গ্রামবাসীর মধ্যে।
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে প্রশাসন উদ্যোগ নেয়। জেলা শাসক শামা পারভিন জরুরি বৈঠক ডাকেন স্বাস্থ্য দফতর, প্রাণী সম্পদ দফতরসহ বিভিন্ন দফতরের আধিকারিকদের নিয়ে। বৈঠকে পোল্ট্রি ফার্ম কর্তৃপক্ষকে ডেকে জানানো হয়, ফার্ম পরিচালনার জন্য যে সমস্ত কাগজপত্র প্রয়োজন তার অনেকটাই নেই। তাই অবিলম্বে প্রয়োজনীয় নথি সংগ্রহ করে জমা দিতে বলা হয়। কাগজপত্র জমা না দেওয়া পর্যন্ত সাত দিনের জন্য ফার্ম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।
গ্রামবাসীর স্বস্তি, শ্রমিকদের হতাশা
গ্রামবাসীরা প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তে খুশি। তাঁদের বক্তব্য, ডিম উৎপাদন গুরুত্বপূর্ণ হলেও মানুষের স্বাস্থ্য আগে। চেকরমারির বাসিন্দা লাল্টু দাস বলেন, “আমাদের গ্রামের বহু মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। জন্ডিস ও লেপ্টোস্পাইরোসিসে কষ্ট পাচ্ছে সবাই। তাই ফার্ম বন্ধের সিদ্ধান্ত সঠিক।”
অন্যদিকে স্থানীয় শ্রমিক ও ফার্ম কর্মীরা গভীর অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। ফার্মে কাজ করা মহম্মদ রকবুল বলেন, “এই প্রকল্পের জন্যই আমাদের জমি নেওয়া হয়েছিল। পরিবারের অনেকেই এখানে কাজ করছে। ফার্ম বন্ধ হলে আমরা কীভাবে চলব বুঝতে পারছি না।” একই সুর ফার্ম ম্যানেজার রঞ্জিৎ সরকারের গলায়, “আমাদের কাগজপত্রের খামতি যত দ্রুত সম্ভব পূরণ করা হবে। তবে ফার্ম বন্ধ হয়ে গেলে প্রচুর মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে।”
ব্যবসায়ী মহলের উদ্বেগ
নর্থ বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিজ (Jalpaiguri) অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সুরজিৎ পাল জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী নিজে রাজ্যে ডিম উৎপাদন বাড়ানোর জন্য উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। সেই আবেদনের পরই অন্ধ্রপ্রদেশের এই সংস্থা বিনিয়োগ করে ফার্ম তৈরি করেছিল। তাঁর মতে, “এটি বন্ধ হলে রাজ্যের শিল্পক্ষেত্রে বড় ক্ষতি হবে। ডিমের ঘাটতি বাড়বে এবং রাজ্যের আর্থিক ক্ষতিও কম হবে না।”
মালিকপক্ষের বক্তব্য
ফার্মের মালিক অশোক রেড্ডি জানান, “আমরা ৪০ কোটি টাকারও বেশি খরচ করে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে এই ফার্ম তৈরি করেছি। প্রতিদিন এক লক্ষেরও বেশি ডিম উৎপাদিত হচ্ছে। হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে শুধু আমাদের ব্যবসাই নয়, রাজ্যেরও ক্ষতি হবে। আমরা প্রশাসনের সব শর্ত পূরণ করতে প্রস্তুত।”
ভবিষ্যৎ কোন পথে?
এই মুহূর্তে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, স্বাস্থ্য সুরক্ষার কারণে ফার্ম বন্ধ রাখা কি স্থায়ী হবে, নাকি কাগজপত্র জমা দিয়ে শিগগিরই পুনরায় চালু করা যাবে? প্রশাসন জানিয়েছে, জল ও পরিবেশ সংক্রান্ত পরীক্ষার রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। তবে শ্রমিক, ব্যবসায়ী এবং মালিকপক্ষ মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়ে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার আবেদন জানাবেন।