নতুন প্রজন্মের পণ্য ও পরিষেবা কর সংস্কারের (GST Reforms) গুরুত্ব তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘোষণার পরই অর্থ মন্ত্রণালয় এক বড় পদক্ষেপ নিল। বর্তমান চার-স্তরের কর কাঠামো থেকে সরে এসে এবার দুই স্ল্যাবের জিএসটি ব্যবস্থার প্রস্তাব দিল কেন্দ্র। এর সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের জন্য বিশেষ কর হার রাখার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। এই প্রস্তাব ইতিমধ্যেই জিএসটি কাউন্সিলের গঠিত মন্ত্রীদের গোষ্ঠী (GoM)-এর কাছে পাঠানো হয়েছে, যারা কর কাঠামোর যৌক্তিকীকরণ এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা করবে।
মোদীর স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে জিএসটি সংস্কারের ইঙ্গিত:
৭৯তম স্বাধীনতা দিবসে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, “জিএসটি সংস্কার সাধারণ মানুষের করের বোঝা অনেকটাই কমিয়ে দেবে এবং ক্ষুদ্র শিল্পকে আরও সুবিধা দেবে। এই সংস্কার দীপাবলির আগেই কার্যকর হবে।” তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরও শক্তিশালী করতে এবং ব্যবসার সুবিধা বাড়াতে জিএসটি কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন আনা জরুরি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তিনটি প্রধান স্তম্ভের রূপরেখা:
মোদীর ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই অর্থ মন্ত্রণালয় ‘এক্স’ (পূর্বতন টুইটার)-এ পোস্ট করে জানায়, প্রস্তাবিত জিএসটি সংস্কার তিনটি মূল স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে তৈরি—
1. কাঠামোগত সংস্কার – কর ব্যবস্থার জটিলতা দূর করে সহজ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া প্রবর্তন।
2. হার যৌক্তিকীকরণ – বর্তমান চার স্ল্যাবের পরিবর্তে দুই স্ল্যাবের কর ব্যবস্থা প্রবর্তন।
3. জীবনযাপনের সহজীকরণ – সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে করের বোঝা কমিয়ে পণ্য ও পরিষেবার প্রাপ্যতা বাড়ানো।
বর্তমান বনাম প্রস্তাবিত কর কাঠামো:
বর্তমানে জিএসটি কাঠামোতে চারটি স্ল্যাব রয়েছে—৫%, ১২%, ১৮% এবং ২৮%। এই ব্যবস্থা চালু হয়েছিল ২০১৭ সালের ১ জুলাই, যার মাধ্যমে ভ্যাট, এক্সসাইজ ডিউটি, সার্ভিস ট্যাক্সসহ একাধিক রাজ্য ও কেন্দ্রীয় কর একত্রিত হয়েছিল। তবে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এবং অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছিলেন যে, চার স্ল্যাবের কাঠামো ব্যবসার পরিকল্পনা ও কর প্রশাসনের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি করছে।
কেন্দ্রের প্রস্তাব অনুযায়ী, শিগগিরই এই চার স্ল্যাবের বদলে থাকবে মাত্র দুটি—
স্ট্যান্ডার্ড স্ল্যাব, মেরিট স্ল্যাব (যেখানে প্রয়োজনীয় পণ্য ও পরিষেবার উপর কম কর আরোপ করা হবে)।
এছাড়াও কিছু নির্দিষ্ট পণ্যের জন্য বিশেষ কর হার রাখা হবে, যাতে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বা রাজস্ব আয়ের জন্য অপরিহার্য পণ্যে কর নীতি আলাদা রাখা যায়।
সাধারণ মানুষের জন্য স্বস্তির বার্তা:
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, দৈনন্দিন ব্যবহার্য পণ্য এবং ‘আকাঙ্ক্ষিত’ পণ্যের উপর কর কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এর ফলে—
পণ্যের দাম কমবে, চাহিদা ও ভোগ বৃদ্ধি পাবে, অর্থনীতিতে গতি আসবে, বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে।
মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই পদক্ষেপ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে প্রয়োজনীয় ও বিলাসপণ্যের প্রাপ্যতা বাড়াবে এবং ক্রয়ক্ষমতাও উন্নত করবে।
সম্মিলিত আলোচনার পরিবেশ গড়ে তোলা:
কেন্দ্র সরকার বলেছে, এই সিদ্ধান্তের লক্ষ্য হল একটি গঠনমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ঐকমত্যভিত্তিক সংলাপ তৈরি করা। এজন্য সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, ব্যবসায়ী সংগঠন, শিল্পক্ষেত্রের প্রতিনিধি এবং কর বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হবে।
সেপ্টেম্বরে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক:
জিএসটি কাউন্সিলের আসন্ন বৈঠক সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হবে। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের নেতৃত্বে এই বৈঠকে মন্ত্রীদের গোষ্ঠীর (GoM) প্রস্তাবিত কর কাঠামো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। যদি এখানে সব পক্ষের সম্মতি মেলে, তবে দীপাবলির আগে নতুন জিএসটি কাঠামো কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
জিএসটির আট বছরের যাত্রা ও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা:
জিএসটি চালুর আট বছর পূর্তিতে মোদী বলেছেন, “এই কর ব্যবস্থায় সংস্কারের সময় এসেছে।”
২০১৭ সালে চালুর সময় জিএসটি-কে দেশের ‘সবচেয়ে বড় কর সংস্কার’ বলা হয়েছিল। এটি রাজ্য ও কেন্দ্রের কর ব্যবস্থাকে একত্রিত করে একটি একক কর ব্যবস্থা গড়ে তোলে। তবে বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে নানা জটিলতা, কর স্ল্যাবের অসামঞ্জস্যতা এবং কিছু খাতে উচ্চ কর হার নিয়ে বিতর্ক হয়েছে বারবার।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নতুন দুই স্ল্যাবের ব্যবস্থা প্রয়োগ হলে—
ব্যবসা করা সহজ হবে, কর ফাঁকি দেওয়া কঠিন হবে, কর প্রশাসন সহজ হবে, সাধারণ মানুষের উপর করের চাপ কমবে।
আগামী দিনের সম্ভাবনা:
যদিও প্রস্তাবটি এখনও চূড়ান্ত নয়, তবুও অর্থনীতিবিদ ও শিল্পমহল নতুন কাঠামোকে স্বাগত জানিয়েছে। তাঁদের মতে, যদি সরকার সঠিকভাবে এটি বাস্তবায়ন করতে পারে, তবে এটি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগকে আরও গতিশীল করবে এবং দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
তবে কিছু রাজ্যের আশঙ্কা রয়েছে যে, কর কাঠামোতে পরিবর্তন আনলে প্রাথমিকভাবে রাজস্ব আয়ে সাময়িক প্রভাব পড়তে পারে। এজন্য তারা বিশেষ ক্ষতিপূরণ প্যাকেজের দাবি তুলতে পারে।
সবমিলিয়ে, আগামী সেপ্টেম্বরে জিএসটি কাউন্সিলের বৈঠক এবং তাতে নেওয়া সিদ্ধান্ত দেশের কর ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিতে পারে। দীপাবলির আগেই যদি এই সংস্কার বাস্তবায়িত হয়, তবে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে শুরু করে শিল্পমহলের হিসাব—সবেতেই বড়সড় প্রভাব পড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে।