লাগাতার বর্ষণে যখন উত্তর (North Bengal) ও দক্ষিণবঙ্গের একাধিক এলাকা প্লাবিত, বহু মানুষের ঘরবাড়ি জলের তলায়, ফসল নষ্ট হয়ে বিপাকে কৃষকরা—তখনই অন্য এক চিত্র দেখা যাচ্ছে চা বাগান এলাকাগুলোতে। অনাবৃষ্টি ও তীব্র গরমের পর অবশেষে পর্যাপ্ত বৃষ্টি পেয়ে হাসি ফুটেছে চা চাষিদের মুখে। তাঁদের আশা, এই বৃষ্টির জোরে কমবে রোগ-পোকার আক্রমণ, বেড়ে যাবে চা পাতার উৎপাদন, আর সেই সঙ্গে মিলবে কিছুটা আর্থিক স্বস্তি।
ক্ষুদ্র(North Bengal) চা চাষি সংগঠন সূত্রে জানা গিয়েছে, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার,(North Bengal) উত্তর দিনাজপুর এবং শিলিগুড়ি মহকুমা মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার ছোট চা বাগান রয়েছে। এই সমস্ত বাগান থেকে বছরে গড়ে ১,২৫০ মিলিয়ন কেজি কাঁচা চা পাতা উৎপাদিত হয়। শুধু তাই নয়, এই বাগানগুলোতে প্রায় এক লক্ষ শ্রমিক কাজ করেন। অনাবৃষ্টির কারণে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাগানগুলির অবস্থা বেহাল ছিল। মাটি শুকিয়ে গিয়েছিল, নতুন পাতার বৃদ্ধি কমে গিয়েছিল, আর শ্রমিক ও মালিক—দু’পক্ষেরই ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল।
উত্তরবঙ্গে সাধারণত বর্ষা ঢোকে ১০ জুনের আশেপাশে। কিন্তু এ বছর তারও আগে, ২৯ মে বর্ষা প্রবেশ করলেও শুরুতে একটানা বৃষ্টি দেখা যায়নি। মাঝেমধ্যে অল্প বৃষ্টি হলেও তা ফসলের পক্ষে কার্যকর ছিল না। চা বাগানের শ্রমিকদের অভিযোগ, প্রয়োজনীয় জল না থাকায় গাছের শারীরিক বৃদ্ধি থমকে গিয়েছিল। এদিকে গরমে তাপমাত্রা ৩৫-৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে গিয়েছিল। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকায় লুপার ও লাল মাকড়সার মতো ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের আক্রমণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।
এই লুপার পোকা রাতারাতি বাগানের পাতার বড় অংশ খেয়ে ফেলে, যার ফলে গাছ দুর্বল হয়ে যায় এবং নতুন কুঁড়ি বেরোতে দেরি হয়। অনেক বাগানে হেক্টরের পর হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় একদিকে যেমন বাগান মালিকদের মাথায় হাত, অন্যদিকে শ্রমিকদের আয় কমে যাওয়ার ভয় তৈরি হয়েছিল।
ঠিক এই সময়ই, পরিস্থিতি পাল্টে দেয় আকাশ থেকে নামা টানা বৃষ্টি। জুনের শেষ সপ্তাহ থেকেই শুরু হওয়া ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ চা বলয় জুড়ে এনে দিয়েছে স্বস্তি। মাটির আর্দ্রতা ফিরে আসায় গাছের বৃদ্ধি আবারও স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বৃষ্টি শুধু মাটি ভিজিয়েই রাখছে না, রোগ-পোকার উপদ্রবও অনেকটা কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে আগামী কয়েক সপ্তাহে চা পাতা উৎপাদন বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল।
ক্ষুদ্র চা চাষিরা বলছেন, অনাবৃষ্টির জন্য উৎপাদনে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছিল, তা হয়তো পুরোপুরি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না, তবে বড়সড় ক্ষতি এড়ানো যাবে। পাশাপাশি, শ্রমিকদের জন্যও এটি এক স্বস্তির খবর—কাজের দিন বাড়বে, আয় বাড়বে, এবং আর্থিক চাপ কিছুটা হলেও কমবে।
যদিও এই বৃষ্টি অন্যদিকে বিপদ ডেকে এনেছে বহু জায়গায়। নদী-নালা উপচে প্লাবিত হয়েছে বসতভিটে, বহু চাষের জমি জলের তলায়। তাই এক অঞ্চলের জন্য যে বৃষ্টি আশীর্বাদ, অন্য অঞ্চলের জন্য সেটাই অভিশাপ হয়ে উঠেছে।
তবুও চা বলয়ে এখন উৎসবের আমেজ। চাষিরা আশা করছেন, প্রকৃতি যদি এভাবে সঙ্গ দেয়, তবে আসন্ন মৌসুমে চা পাতার গুণমান ও পরিমাণ—দুটোই উন্নত হবে। আর এই উন্নতি শেষমেশ দেশের চা বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। প্রবাদ বাক্যটি আবারও সত্যি প্রমাণিত হচ্ছে—কারও পৌষ মাস, তো কারও সর্বনাশ।