ভারতে ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থার সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যমগুলির একটি হল ইউপিআই (Unified Payments Interface)। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয় গুগল পে (GPay), ফোনপে (PhonePe), পেটিএম (Paytm) সহ বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে। কিন্তু এবার এই ব্যবস্থায় আসছে একটি বড় পরিবর্তন। ন্যাশনাল পেমেন্টস কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (NPCI) ঘোষণা করেছে যে ২০২৫ সালের ১ অক্টোবর থেকে ইউপিআই-এর পি-টু-পি (Person-to-Person) ‘কলেক্ট রিকোয়েস্ট’ ফিচার স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাবে।
কী এই ‘কলেক্ট রিকোয়েস্ট’ ফিচার?
‘কলেক্ট রিকোয়েস্ট’ বা Pull Transaction এমন একটি ফিচার, যেখানে ব্যবহারকারী অন্য কারও কাছ থেকে টাকা রিকোয়েস্ট করতে পারতেন। উদাহরণস্বরূপ, বন্ধুর সঙ্গে খাবারের বিল ভাগ করা, ধার নেওয়া টাকা ফেরতের জন্য রিমাইন্ডার পাঠানো বা অন্যান্য ব্যক্তিগত পেমেন্টের জন্য অনেকেই এই ফিচার ব্যবহার করতেন। প্রাপক (Receiver) অনুরোধ গ্রহণ করলেই অর্থ সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের (Requester) অ্যাকাউন্টে চলে যেত।
কেন বন্ধ হচ্ছে এই ফিচার?
NPCI-এর মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ফিচারটি সাইবার প্রতারণার বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। প্রতারকরা মিথ্যা অজুহাতে অচেনা বা অল্প পরিচিত ব্যক্তিদের কাছে পেমেন্ট রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিত। অনেক সময় ব্যবহারকারীরা না বুঝে বা ভুলবশত সেই রিকোয়েস্ট অ্যাপ্রুভ করে ফেলতেন, ফলে টাকা সরাসরি প্রতারকের অ্যাকাউন্টে চলে যেত।
এর আগে প্রতারণা ঠেকাতে NPCI এই ফিচারের লেনদেনের সীমা ২,০০০ টাকা পর্যন্ত বেঁধে দিয়েছিল। সীমা কার্যকর হওয়ার পর প্রতারণার কিছুটা হ্রাস হলেও, পুরোপুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। তাই পুরো ফিচারটি স্থায়ীভাবে বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
NPCI-এর অফিসিয়াল ঘোষণা:
NPCI ২৯ জুলাই ২০২৫-এ একটি অফিসিয়াল সার্কুলার জারি করে জানিয়েছে যে ১ অক্টোবর ২০২৫-এর পর থেকে সমস্ত ব্যাংক ও ইউপিআই অ্যাপ পি-টু-পি কলেক্ট রিকোয়েস্ট তৈরি, পাঠানো, রাউটিং বা প্রসেস করতে পারবে না। অর্থাৎ, ব্যবহারকারীরা আর বন্ধু বা পরিবারের কাছ থেকে ইউপিআই রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে টাকা নিতে পারবেন না।
এরপর কীভাবে টাকা পাঠানো যাবে?
ফিচার বন্ধ হয়ে গেলে ইউপিআই-এর মাধ্যমে টাকা পাঠানোর জন্য ব্যবহারকারীদের কয়েকটি বিকল্প পদ্ধতি বেছে নিতে হবে—
QR কোড স্ক্যান করে টাকা পাঠানো
কন্টাক্ট লিস্ট থেকে নাম সিলেক্ট করে টাকা পাঠানো
UPI আইডি বা মোবাইল নম্বর দিয়ে ট্রান্সফার করা
এই ক্ষেত্রে প্রেরক (Sender) নিজে থেকেই টাকা পাঠাবেন এবং প্রতিটি লেনদেনের জন্য UPI পিন দিয়ে অথেন্টিকেশন করতে হবে।
মার্চেন্ট পেমেন্টে প্রভাব পড়বে না:
NPCI স্পষ্ট করে জানিয়েছে, এই পরিবর্তন শুধুমাত্র P2P Collect Request-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। মার্চেন্ট পেমেন্ট বা ব্যবসায়িক লেনদেনে কলেক্ট রিকোয়েস্ট চালু থাকবে। যেমন—আমাজন, ফ্লিপকার্ট, সুইগি, জোম্যাটো, আইআরসিটিসি-র মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পেমেন্ট করার সময় যে UPI Collect Request আসে, তা ব্যবহারকারীর অনুমতি এবং UPI পিন ছাড়া সম্পন্ন হয় না, তাই এই ধরণের লেনদেন নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সাইবার সুরক্ষার জন্য বড় পদক্ষেপ:
ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থায় প্রতারণার ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘কলেক্ট রিকোয়েস্ট’ বন্ধ করা একটি বড় এবং ইতিবাচক পদক্ষেপ, যা ব্যবহারকারীদের অজান্তে টাকা হারানোর ঝুঁকি অনেকটা কমাবে। বিশেষ করে বয়স্ক বা প্রযুক্তিতে কম দক্ষ মানুষরা এর ফলে অনেক বেশি সুরক্ষিত থাকবেন।
ব্যবহারকারীদের জন্য সতর্কবার্তা:
১ অক্টোবরের আগে যেসব ব্যবহারকারী এখনও এই ফিচার ব্যবহার করছেন, তাদের NPCI ও ব্যাংকগুলির পক্ষ থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে—
অচেনা কারও রিকোয়েস্ট কখনও গ্রহণ করবেন না
লেনদেনের আগে প্রতিবার বিস্তারিত যাচাই করুন
UPI পিন কখনও অন্য কারও সাথে শেয়ার করবেন না
ইউপিআই-এর ভবিষ্যৎ ও নিরাপত্তা:
২০১৬ সালে চালু হওয়ার পর থেকে ইউপিআই ভারতে ডিজিটাল অর্থ লেনদেনের চিত্র বদলে দিয়েছে। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ৪০০ কোটিরও বেশি লেনদেন হয় ইউপিআই-এ। তবে ব্যবস্থার জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে প্রতারণার ধরনও বেড়েছে। NPCI এখন নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরও কড়া সিকিউরিটি প্রোটোকল চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।
যদিও P2P Collect Request ফিচার বন্ধ হওয়ায় কিছু ব্যবহারকারীর সুবিধা কমে যাবে, তবে ডিজিটাল নিরাপত্তার দিক থেকে এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ব্যবহারকারীদের এখন থেকে নিজেরাই লেনদেন শুরু করতে হবে, যাতে প্রতারণার সুযোগ অনেকটাই হ্রাস পায়।
ডিজিটাল যুগে “সতর্ক থাকাই সুরক্ষার চাবিকাঠি”—এই বার্তাই দিচ্ছে NPCI-এর এই সিদ্ধান্ত।