রাজ্য রাজনীতিতে (West Bengal politics) নতুন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে পুলিশ-পত্নীদের সাংবাদিক সম্মেলন। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর মন্তব্যের প্রতিবাদে এই সম্মেলনের আয়োজন হয়েছিল, কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত ব্যুমেরাং প্রমাণিত হয়েছে বলে রাজনৈতিক মহলের একাংশের মত। প্রশ্ন উঠছে—এই পরিস্থিতিতে কেন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাকর্মীরা নীরব? কেবলমাত্র কুণাল ঘোষ ছাড়া দলের অন্য নেতারা কেন পুলিশ-পত্নীদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন না?
ঘটনার সূত্রপাত ৯ই অগাস্টে। ঠিক এক বছর আগে রাজ্যে বহুল আলোচিত আরজি কর হাসপাতালের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনার বর্ষপূর্তিতে নির্যাতিতার পরিবার নবান্ন অভিযানের ডাক দেয়। কর্মসূচিতে যোগ দেন বিজেপির শীর্ষ নেতারা ও কর্মীরা। এই সময় কলকাতা পুলিশের নগরপাল মনোজ ভর্মাকে লক্ষ্য করে তীব্র ভাষায় আক্রমণ শানান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। অভিযোগ, তিনি নগরপালকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।
এই বক্তব্যের পরই সরব হন পুলিশের স্ত্রীদের একাংশ। তৃণমূলের কৌশলে তারা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। উদ্দেশ্য ছিল, বিরোধী নেতার মন্তব্যের বিরোধিতা করা এবং পুলিশের মর্যাদা রক্ষা করা। কিন্তু সাংবাদিকদের তীক্ষ্ণ প্রশ্নে তাঁরা হোঁচট খান। বিশেষ করে, অনুব্রত মণ্ডলের অতীত মন্তব্যের প্রসঙ্গ উঠে আসতেই পরিস্থিতি জটিল হয়। সাংবাদিকদের প্রশ্ন—কয়েক মাস আগে অনুব্রত মণ্ডল এক পুলিশকর্তাকে গালিগালাজ করে তাঁর স্ত্রী ও মাকে ধর্ষণের হুমকি দিয়েছিলেন, তখন কেন পুলিশের ঘরনীরা মুখ খোলেননি? এই প্রশ্নে কার্যত কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি পুলিশ-পত্নীরা।
এখানেই শেষ নয়। আলোচনায় আসে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির ঘটনা, যখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং একাধিক পুলিশকর্তাকে প্রকাশ্যে আক্রমণ করেছিলেন এবং পুলিশকে চড় মারার হুমকিও দিয়েছিলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল—তখনও তো আপনারা চুপ ছিলেন? কেন সেই সময় পুলিশের পাশে দাঁড়াননি? এই প্রশ্নেও নীরবতা বজায় রাখেন পুলিশ-পত্নীরা।
এই সম্মেলনের পর বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর আইনজীবী তিন পুলিশ দম্পতিকে আইনি নোটিস পাঠিয়েছেন। রাজনৈতিক মহল মনে করছে, পুলিশের পরিবারের তরফে এই পদক্ষেপ তাদের জন্য বরং বিপদ ডেকে এনেছে। তৃণমূলের ‘স্টাইল’ নকল করার চেষ্টা উল্টো ফল দিয়েছে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়, এই ঘটনার পর তৃণমূল কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতা এই ইস্যুতে সেভাবে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। কেবলমাত্র দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত পুলিশ-পত্নীদের প্রশ্ন করা সংবাদমাধ্যমকে কটাক্ষ করেছেন। তাঁর বক্তব্য নিয়ে আবারও নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। অনেকের মতে, কুণাল ঘোষের প্রতিক্রিয়া দলের অফিসিয়াল অবস্থান বলেই ধরে নেওয়া হয়, অথচ সেই অবস্থানকে দলের অন্য নেতারা প্রচার করছেন না।
তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, পুলিশের পরিবারের এই সম্মেলনকে ঘিরে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তাতে দল অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়েছে। কারণ, পুলিশের ঘরনীদের বক্তব্যের অসঙ্গতি ও অতীত নীরবতার কারণে বিরোধীরা তীব্র আক্রমণ শানানোর সুযোগ পেয়ে গেছে। ফলে, সরাসরি সমর্থন জানালে তৃণমূলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে—এমন আশঙ্কাই দলে প্রভাব ফেলেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনার প্রেক্ষিতে তৃণমূলের দ্বিধা প্রকট হয়ে উঠেছে। একদিকে, পুলিশ প্রশাসন ও তাদের পরিবারকে খুশি রাখা দরকার, অন্যদিকে, অতীতের ঘটনায় দলের বিতর্কিত ভূমিকা সামনে আসায় সরাসরি সমর্থন জানাতে অনীহা। এই পরিস্থিতি বিরোধীদের হাতে শক্তিশালী হাতিয়ার তুলে দিয়েছে।
সব মিলিয়ে, শুভেন্দু বিরোধী স্লোগান তোলার জন্য আয়োজিত পুলিশ-পত্নীদের সাংবাদিক সম্মেলন রাজ্য রাজনীতিতে তৃণমূলের জন্য ‘বুমেরাং’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই কারণেই হয়তো অধিকাংশ তৃণমূল নেতা এই ইস্যুতে মুখ খুলতে নারাজ। আপাতত কেবল কুণাল ঘোষের তীক্ষ্ণ মন্তব্যই শোনা যাচ্ছে, বাকিরা নিশ্চুপ। কিন্তু এই নীরবতা কতটা কৌশলগত, আর কতটা অস্বস্তির প্রতিফলন—সেটাই এখন দেখার বিষয়।