কিষাণ ক্রেডিট কার্ড বনাম ব্যক্তিগত ঋণ! গ্রামীণ ঋণগ্রহীতাদের জন্য কোনটি ভালো?

ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতিতে ঋণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে কৃষক এবং গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের জন্য। কৃষি এবং সম্পর্কিত কার্যক্রমের জন্য কিষাণ ক্রেডিট কার্ড (Kisan…

Kisan Credit Card vs Personal Loan

ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতিতে ঋণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে কৃষক এবং গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের জন্য। কৃষি এবং সম্পর্কিত কার্যক্রমের জন্য কিষাণ ক্রেডিট কার্ড (Kisan Credit Card) এবং ব্যক্তিগত ঋণ (Personal Loan) দুটি জনপ্রিয় আর্থিক সরঞ্জাম। তবে, গ্রামীণ ঋণগ্রহীতাদের জন্য কোনটি বেশি উপযুক্ত—কেসিসি নাকি ব্যক্তিগত ঋণ? এই নিবন্ধে আমরা উভয়ের বৈশিষ্ট্য, সুবিধা, এবং অসুিধাগুলি বিশ্লেষণ করে দেখব, যাতে গ্রামীণ ভারতের মানুষ তাদের আর্থিক চাহিদার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

কিষাণ ক্রেডিট কার্ড (কেসিসি) কী?
১৯৯৮ সালে জাতীয় কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন ব্যাঙ্ক (নাবার্ড) কর্তৃক চালু কিষাণ ক্রেডিট কার্ডঙ্ স্কিম কৃষকদের জন্য একটি বিশেষ ঋণ সুবিধা। এই প্রকল্পের লক্ষ্য কৃষকদের কৃষি কার্যক্রমের জন্য সহজলভ্য এবং কম সুদে ঋণ প্রদান করা। কেসিসি কৃষকদের বীজ, সার, কীটনাশক কেনার জন্য স্বল্পমেয়াদি ঋণ এবং ফসল কাটার পরে পরিবহন ও সংরক্ষণের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করে ২০০৪ সালে এই প্রকল্পের আওতা বাড়িয়ে পশুপালন, মৎস্য চাষ, এবং অন্যান্য সম্পর্কিত কার্যক্রমের জন্যও ঋণ দেওয়া শুরু হয়।

   

২০২৫ সালে সরকার কেসিসি ঋণের সীমা ৩ লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লক্ষ টাকা করেছে, যা প্রায় ৭.৭ কোটি কৃষকের জন্য উপকারী। এই ঋণ জামানতবিহীন এবং ৭% সরল সুদের হারে পাওয়া যায়। এছাড়া, সময়মতো ঋণ পরিশোধে ৩% সুদের ছাড় দেওয়া হয়। কেসিসি-র মাধ্যমে কৃষকরা ফসলের বীমা, দুর্ঘটনা বীমা (৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত মৃত্যু বা স্থায়ী অক্ষমতার জন্য), এবং একক উইন্ডোর মাধ্যমে সহজ আবেদন প্রক্রিয়ার সুবিধা পান। ২০২৪ সাল পর্যন্ত, কেসিসি-র মাধ্যমে ১০ লক্ষোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, যা ৭.৭২ কোটি কৃষকের কাছে পৌঁছেছে।

ব্যক্তিগত ঋণ কী?
ব্যক্তিগত ঋণ হল একটি অ-জামানতবিহীন ঋণ, যা গ্রামীণ এবং শহুরে উভয় ঋণগ্রহীতারা বিভিন্ন ব্যক্তিগত প্রয়োজনের জন্য নিতে পারেন, যেমন চিকিৎসা, শিক্ষা, বা ব্যবসায়িক বিনিয়োগ। গ্রামীণ ভারতে, ফিনটেক কোম্পানি এবং ব্যাঙ্কগুলি ছোট-মাঝারি টিকিটের ব্যক্তিগত ঋণ প্রদান করে, যার পরিমাণ ১,০০০ থেকে ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এই ঋণের সুদের হার সাধারণত ১০-২৪% এবং মেয়াদ ১ থেকে ৫ বছর হয়। ফিনটেক প্ল্যাটফর্মগুলি আধার-ভিত্তিক ই-কেওয়াইসি এবং বিকল্প ক্রেডিট স্কোরিং মডেল ব্যবহার করে দ্রুত ঋণ অনুমোদন করে, যা ক্রেডিট ইতিহাসবিহীন ব্যক্তিদের জন্য উপযোগী।

কেসিসি এবং ব্যক্তিগত ঋণের তুলনা
১. উদ্দেশ্য: কেসিসি প্রাথমিকভাবে কৃষি এবং সম্পর্কিত কার্যক্রমের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যেমন ফসল চাষ, পশুপালন, বা মৎস্য চাষ। ব্যক্তিগত ঋণের কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নেই এবং এটি যেকোনো ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়।
২. সুদের হার: কেসিসি ঋণের সুদের হার ৭% (৩% ছাড় সহ ৪% পর্যন্ত), যা ব্যক্তিগত ঋণের তুলনায় অনেক কম। ব্যক্তিগত ঋণের সুদের হার ১০-২৪% হতে পারে।
৩. জামানত: কেসিসি ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জামানতবিহীন ঋণ প্রদান করে, যেখানে ব্যক্তিগত ঋণও সাধারণত জামানতবিহীন হয়। তবে, ব্যক্তিগত ঋণের জন্য ক্রেডিট স্কোরের প্রয়োজন হতে পারে।
৪. আবেদন প্রক্রিয়া: কেসিসি-র জন্য একটি সরল এক-পৃষ্ঠার ফর্ম এবং পিএম-কিষাণ পোর্টালের মাধ্যমে আবেদন করা যায়। ব্যক্তিগত ঋণের জন্য ফিনটেক প্ল্যাটফর্ম ব ব্যাঙ্কে আধার এবং অন্যান্য নথি জমা দিতে হয়।
৫. বীমাুবিধা: কেসিসি ফসলের বীমা এবং দুর্ঘটনা বীমা প্রদান করে, যা ব্যক্তিগত ঋণে সাধারণত পাওয়া যায় না।

গ্রামীণ ঋণগ্রহীতাদের জন্য কোনটি ভালো?
কৃষক এবং কৃষি-সম্পর্কিত কার্যক্রমে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য কেসিসি স্পষ্টভাবে বেশি উপযোগী। এর নিম্ন সুদের হার, জামানতবিহীন ঋণ, এবং বীমা সুবিধা কৃষকদের আর্থিক ঝুঁকি কমায়। উদাহরণস্বরূপ, ওড়িশার একজন কৃষক নবীন বলেছেন, তিনি কেসিসি-র মাধ্যমে ২৭,০০০ টাকার ঋণ নিয়েছিলেন মাত্র ৪% সুদে, যেখানে মধ্যস্থতাকারীরা ২০% সুদ নিত।

Advertisements

অন্যদিকে, ব্যক্তিগত ঋণ গ্রামীণ উদ্যোক্তা বা অ- বকৃষি কার্যক্রমে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য উপযুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, একজন গ্রামীণ ব্যবসায়ী যিনি ছোট দোকান বা হস্তশিল্প ব্যবসা শুরু করতে চান, তারা ব্যক্তিগত ঋণের নমনীয়তা থেকে উপকৃত হতে পারেন। ফিনটেক প্ল্যাটফর্মগুলি ডিজিটাল লেনদেন এবং ইউটিলিটি বিলের ভিত্তিতে ক্রেডিট স্কোর তৈরি করে দ্রুত ঋণ প্রদান করে।

চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
কেসিসি-র ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন ঋণের অপব্যবহার এবং সময়মতো পরিশোধ না করা। ২০২৪ সালে, বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিতিে কেসিসি ঋণে খেলাপি ঋণ ৪২% বেড়েছে। এছাড়া, কিছু অঞ্চলে ঋণের পরিমাণ অপর্যাপ্ত এবং সময়মতো পাওয়া যায় না। ব্যক্তিগত ঋণের ক্ষেত্রে উচ্চ সুদের হার এবং ক্রেডিট স্কোরের প্রয়োজন গ্রামীণ ঋণগ্রহীতাদের জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে।
এই সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার কিষাণ রিন পোর্টাল চালু করেছে, যা ঋণ প্রক্রিয়া ডিজিটাইজ করেছে। এছাড়া, ব্যাঙ্কগুলিকে কেসিসি আবেদনের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা এবং স্বচ্ছ প্রত্যাখ্যানের কারণ জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে প্রভাব
পশ্চিমবঙ্গে কেসিসি কৃষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, বিশেষ করে মৎস্য চাষ এবং পশুপালনের ক্ষেত্রে। রাজ্যে প্রায় ৫০ লক্ষ কেসিসি সক্রিয় রয়েছে, যা কৃষকদের জন্য আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করছে। ব্যক্তিগত ঋণ গ্রামীণ মহিলা উদ্যোক্তা এবং স্ব-সহায়ক গোষ্ঠীর (এসএইচজি) মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

কিষাণ ক্রেডিট কার্ড কৃষকদের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত, যারা কৃষি এবং সম্পর্কিত কার্যক্রমে নিয়োজিত। এর কম সুদের হার, বীমা সুবিধা, এবং জামানতবিহীন ঋণ কৃষকদের আর্থিক ঝুঁকি কমায়। অন্যদিকে, ব্যক্তিগত ঋণ গ্রামীণ উদ্যোক্তা এবং অ-কৃষি কার্যক্রমের জন্য বেশি উপযোগী। গ্রামীণ ঋণগ্রহীতাদের উচিত তাদের প্রয়োজন এবং পরিশোধ ক্ষমতার ভিত্তিতে সঠিক ঋণ বেছে নেওয়া। সরকার এবং ফিনটেক প্ল্যাটফর্মের সমন্বিত প্রচেষ্টা ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করছে।