বর্তমান অনিশ্চিত আর্থিক পরিস্থিতিতে প্রত্যেক পরিবারই চায় তাদের সঞ্চয় যেন নিরাপদ থাকে এবং সেই সঙ্গে একটি স্থির আয়ের উৎসও নিশ্চিত হয়। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ অনেক সময় বড় মুনাফার পথ খুলে দেয়, তবে এর সঙ্গে রয়েছে বাজারের ওঠানামার ঝুঁকি। এই কারণে বহু মধ্যবিত্ত পরিবার নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিট, পোস্ট অফিসের টার্ম ডিপোজিট, এবং রিকরিং ডিপোজিটের মতো পরীক্ষিত পদ্ধতিকে বেশি ভরসা করে।
পোস্ট অফিসের সঞ্চয় স্কিমের জনপ্রিয়তা:
ভারতীয় ডাকঘর শুধু ডাক পরিষেবা নয়, বরং কোটি কোটি সাধারণ মানুষের জন্য নির্ভরযোগ্য সঞ্চয় স্কিমেরও অন্যতম কেন্দ্র। ডাকঘরের বিভিন্ন সঞ্চয় স্কিম যেমন—রিকরিং ডিপোজিট (RD), টার্ম ডিপোজিট (TD), পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ড (PPF), কিষান বিকাশ পত্র (KVP) এবং মাসিক আয় স্কিম (MIS) — বিনিয়োগকারীদের মূলধন সুরক্ষা এবং নিশ্চিত সুদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য পোস্ট অফিসের মাসিক আয় স্কিম (Monthly Income Scheme বা MIS), যা বিনিয়োগকারীদের প্রতি মাসে নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান করে।
MIS-এর বর্তমান সুদের হার ও বিনিয়োগ সীমা:
বর্তমানে পোস্ট অফিসের মাসিক আয় স্কিমে বার্ষিক ৭.৬% হারে সুদ দেওয়া হয়। এই স্কিমে বিনিয়োগ শুরু করা যায় মাত্র ১,০০০ টাকা থেকে। একক অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ সীমা ৯ লক্ষ টাকা এবং যৌথ অ্যাকাউন্টে (সর্বোচ্চ ৩ জন পর্যন্ত) এই সীমা ১৫ লক্ষ টাকা।
এই স্কিমে বিনিয়োগ করতে হলে পোস্ট অফিসে আপনার একটি সঞ্চয়ী অ্যাকাউন্ট (Savings Account) থাকতে হবে। MIS-এর মেয়াদ ৫ বছর, অর্থাৎ বিনিয়োগের পাঁচ বছর পূর্ণ হলে আপনার মূলধন সম্পূর্ণ ফেরত দেওয়া হবে, সঙ্গে থাকবে পাঁচ বছরের জন্য নিয়মিত মাসিক আয়।
মাসিক আয়ের নির্ভুল হিসাব:
ধরা যাক, আপনি এই স্কিমে ১ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করলেন। বর্তমান ৭.৬% বার্ষিক সুদের হারে প্রতি মাসে আপনি পাবেন প্রায় ৬৩৩ টাকা সুদ। অর্থাৎ পাঁচ বছরের পুরো মেয়াদে মাসে মাসে স্থির আয়ের নিশ্চয়তা থাকবে, আর মেয়াদ শেষে আপনি আপনার ১ লক্ষ টাকা মূলধন ফেরত পাবেন।
বৃহত্তর বিনিয়োগকারীদের জন্য এই হিসাব আরও আকর্ষণীয়। উদাহরণস্বরূপ—যদি একক অ্যাকাউন্টে সর্বোচ্চ সীমা অনুযায়ী ৯ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করা হয়, তবে প্রতি মাসে প্রায় ৫,৭০০ টাকা সুদ পাওয়া যাবে। যৌথ অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করলে মাসিক আয় দাঁড়াবে প্রায় ৯,৫০০ টাকার কাছাকাছি।
কারা এই স্কিমে বিনিয়োগ করবেন:
MIS মূলত তাদের জন্য উপযুক্ত যারা ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগে বিশ্বাসী এবং মাসে মাসে একটি নির্দিষ্ট আয়ের উৎস চান। অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি, গৃহবধূ, এবং নিয়মিত আয়ের বাইরে বাড়তি স্থায়ী আয় খুঁজছেন এমন বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি আদর্শ বিকল্প।
শেয়ার বাজারের অনিশ্চয়তা কিংবা মিউচুয়াল ফান্ডের ওঠানামা অনেক সময় আর্থিক নিরাপত্তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু MIS-এর ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি নেই, কারণ সরকার এটি পরিচালনা করে এবং মূলধনের সুরক্ষা ১০০% নিশ্চিত।
বিনিয়োগের সুবিধা:
1. নিশ্চিত মাসিক আয় – বাজার পরিস্থিতি যেমনই হোক, প্রতি মাসে নির্ধারিত হারে সুদ পাওয়া যাবে।
2. মূলধন সুরক্ষা – মেয়াদ শেষে আপনার পুরো বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত দেওয়া হবে।
3. সহজ প্রক্রিয়া – পোস্ট অফিসে সঞ্চয়ী অ্যাকাউন্ট থাকলেই সহজে MIS অ্যাকাউন্ট খোলা যায়।
4. অল্প অর্থ দিয়ে শুরু – মাত্র ১,০০০ টাকা বিনিয়োগ করেও এই স্কিমে অংশ নেওয়া সম্ভব।
5. যৌথ অ্যাকাউন্টের সুবিধা – পরিবার বা সঙ্গীর সঙ্গে যৌথভাবে বেশি পরিমাণ বিনিয়োগ করে বেশি মাসিক আয়ের সুযোগ।
সীমাবদ্ধতাও আছে:
তবে এই স্কিমের কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ—
বিনিয়োগের মেয়াদ পাঁচ বছর, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে মূলধন তোলার ক্ষেত্রে কিছু শর্ত প্রযোজ্য।
সুদের হার বাজার পরিস্থিতি ও সরকারি নীতির উপর নির্ভর করে সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হতে পারে।
মুদ্রাস্ফীতির হার যদি বেশি হয়, তবে প্রকৃত আয়ের ক্রয়ক্ষমতা কিছুটা কমতে পারে।
কেন MIS এখনো জনপ্রিয়:
তবুও MIS জনপ্রিয়, কারণ বর্তমান অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময়ে এটি একটি নির্ভরযোগ্য আয়ের উৎস। বিশেষ করে যাদের আয়ের বড় অংশ সুদের উপর নির্ভরশীল, তাদের জন্য এই স্কিম মানসিক শান্তি দেয়। অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে পেনশনের সঙ্গে MIS-এর আয় যোগ হয়ে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করে।
বর্তমান বাজারে বেশ কিছু ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিটের সুদের হার ৬.৫% থেকে ৭% এর মধ্যে ঘোরাফেরা করছে, সেখানে পোস্ট অফিস MIS-এর ৭.৬% সুদের হার একটি বাড়তি সুবিধা।
যারা ঝুঁকি নিতে চান না, নিয়মিত মাসিক আয়ের প্রয়োজন আছে এবং সরকারি সুরক্ষিত বিনিয়োগ চান, তাদের জন্য পোস্ট অফিসের মাসিক আয় স্কিম এক কথায় আদর্শ। এটি শুধু আয়ই দেয় না, আর্থিক ভবিষ্যতের জন্য স্থিতিশীলতারও নিশ্চয়তা দেয়।
এখনকার অনিশ্চিত অর্থনৈতিক পরিবেশে, যেখানে বাজারের ওঠানামা যে কোনো মুহূর্তে বিনিয়োগের মান কমিয়ে দিতে পারে, সেখানে MIS অনেক পরিবারের জন্য এক ধরনের “ফাইন্যান্সিয়াল লাইফ জ্যাকেট” হয়ে দাঁড়িয়েছে—যা ভরসা, আস্থা ও নিশ্চয়তার প্রতীক।