নিজস্ব সংবাদদাতা, পশ্চিম মেদিনীপুর: “১৮ বছরের আগে কোনওভাবেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়া চলবে না”—এই আইন সম্পর্কে পুলিশ প্রশাসন ও সামাজিক সংস্থাগুলি বারবার প্রচার চালালেও, এখনও গ্রামবাংলার বহু জায়গায় নাবালিকা বিয়ের ঘটনা ঘটে চলেছে। তবে এরই মাঝে এক সাহসী কিশোরীর দৃঢ় পদক্ষেপ সমাজে নতুন উদাহরণ গড়ল। পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুরে এক দশম শ্রেণির ছাত্রী নিজের বিয়ে নিজেই বন্ধ করল। তার এই সাহস ও সচেতনতার স্বীকৃতি স্বরূপ জেলা প্রশাসন তাকে কন্যাশ্রী দিবসের (Kanyashree Day) সরকারি অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
ঘটনাটি ঘটেছে বুধবার। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ওই নাবালিকার পরিবার দীর্ঘদিন ধরেই বিয়ের তোড়জোড় করছিল। কিন্তু মেয়ে এখনও ১৮ বছর পূর্ণ করেনি, আইনত যা অপরাধ। সেদিন সকালে হঠাৎ করেই তাকে স্কুলে যেতে দেওয়া হয়নি। এমনকি, বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে তার মোবাইল ফোনও কেড়ে নেওয়া হয়। পরিবারের চাপে নাবালিকা ভয় পায়নি। বরং সুযোগ বুঝে কোনোরকমে একটি ফোন জোগাড় করে স্থানীয় থানায় খবর দেয়।
খবর পাওয়ার পরেই তৎপর হয় পুলিশ। কেশপুর থানার একটি দল এবং জেলা শিশু ও নারী কল্যাণ দপ্তরের আধিকারিকরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছন। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বিয়ের সমস্ত আয়োজন পুরোদমে চলছে—আলো, সাজসজ্জা, রান্নার প্রস্তুতি, এমনকি অতিথিদের জন্য আসনও তৈরি। হঠাৎ পুলিশের উপস্থিতিতে হতচকিত হয়ে পড়েন পরিবারের সদস্যরা।
পুলিশের তরফ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়—১৮ বছরের আগে মেয়ের বিয়ে দেওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ধরনের কাজে জড়িত থাকলে জেল ও জরিমানা দুই-ই হতে পারে। প্রশাসনের কঠোর অবস্থান দেখে অবশেষে পরিবারের সদস্যরা নাবালিকার বিয়ে বন্ধ করতে রাজি হন এবং লিখিত মুচলেকা দেন যে মেয়ের বয়স ১৮ না হওয়া পর্যন্ত তারা বিয়ের কথা ভাববেন না।
এই ঘটনায় এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। অনেকেই জানিয়েছেন, এমন সাহসী পদক্ষেপে তারা গর্বিত। গ্রামের এক প্রবীণ বাসিন্দা বলেন, “এই মেয়ে যা করেছে, তা খুবই প্রশংসনীয়। আমরা চাই, আমাদের গ্রামের অন্য মেয়েরাও যেন নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়।”
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের শিশু, নারী ও জনকল্যাণ দপ্তরের এক আধিকারিক জানান, “আমরা এই কিশোরীর সাহসিকতা ও সচেতনতার জন্য গর্বিত। সে আইন মেনে নিজের বিয়ে রুখেছে, যা অনেক প্রাপ্তবয়স্কও করতে পারেন না। তাই কন্যাশ্রী দিবসের সরকারি অনুষ্ঠানে তাকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, যাতে অন্য মেয়েরা অনুপ্রাণিত হয়।”
কন্যাশ্রী প্রকল্প, যা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে চালু হয়েছিল, মূলত নাবালিকা বিয়ে রোধ ও মেয়েদের শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রশাসনের মতে, এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হল—যদি মেয়েরা সচেতন হয়, তাহলে নাবালিকা বিয়ে অনেকটাই রোধ করা সম্ভব।
ঘটনার পর ওই নাবালিকা জানিয়েছে, “আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই। ১৮ বছর হওয়ার আগে বিয়ে করা উচিত নয়—এ কথা আমি স্কুলে শিক্ষকদের কাছ থেকে জেনেছি। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বিয়ে বন্ধ করব।”
কেশপুরের এই কিশোরীর সাহসিকতা প্রমাণ করে দিল—সচেতনতা ও দৃঢ় মনোভাব থাকলে নিজের ভবিষ্যৎ রক্ষা করা সম্ভব। আর এই উদাহরণ হয়তো আরও বহু মেয়েকে একই পথে হাঁটতে উৎসাহ দেবে।