আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মঞ্চে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে চলেছে, যেখানে চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই’র (Wang ) আগামী ১৮ আগস্ট ভারত সফর দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। এই সফরটি শুধু ভারত ও চিনর মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে সুসংহত করার চেষ্টা নয়, বরং এর প্রতিক্রিয়া পড়বে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর উপরেও। শিরোনামে প্রকাশ পেয়েছে—”পাকিস্তান-বাংলাদেশের ঘুম উড়িয়ে ভারত সফরে চিনের বিদেশমন্ত্রী”—যা ইঙ্গিত দেয়, এই কূটনৈতিক পদক্ষেপ আঞ্চলিক শক্তিসমূহের মধ্যে একটি উত্তালতা সৃষ্টি করতে পারে।
সফরের পটভূমি
২০২০ সালের মে মাসে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ঘটে যাওয়া সীমান্ত সংঘর্ষের পর থেকে ভারত ও চিনর সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ পর্যায়ে রয়েছে। সেই সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় সৈন্য ও চারজন চীনা সৈন্য প্রাণ হারান। তবে গত কয়েক বছরে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ও সামরিক প্রত্যাহারের মাধ্যমে উত্তেজনা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ওয়াং ই’র ভারত সফর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোবালের সঙ্গে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার জন্য নির্ধারিত। এই সাক্ষাতটি শঙ্ঘাই সহযোগিতা সংস্থা (SCO) সম্মেলনের আগে হওয়ায় এর গুরুত্ব আরও বাড়ছে, যেখানে ভারত ও চীন সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করবে।
পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ
পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এই সফরটি একটি বড় চিন্তার কারণ হতে পারে। চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে গভীর সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে, বিশেষ করে চায়না-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (CPEC) প্রকল্পের মাধ্যমে, যা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে, যদি ভারত ও চিনর মধ্যে সম্পর্ক সুস্থ হয়, তাহলে চীন পাকিস্তানের উপর তার নির্ভরশীলতা কমিয়ে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। এটি পাকিস্তানের জন্য একটি ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হবে, বিশেষ করে যেহেতু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে শত্রুতা রয়েছে। পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ এই সফরটি নজরে রেখে তার পরবর্তী কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত হচ্ছে, যা “ঘুম উড়িয়ে” দেওয়ার কারণ হতে পারে।
বাংলাদেশের অবস্থান
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সফরের প্রভাব কিছুটা ভিন্ন। বাংলাদেশ সরাসরি চিনর সঙ্গে এতটা নির্ভরশীল নয়, তবে ভারতের সঙ্গে তার সীমান্ত ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। ভারত-চিনর সম্পর্ক সুস্থ হলে এটি বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে, তবে একই সঙ্গে এটি ভারতের আঞ্চলিক প্রভাব বাড়াতে পারে, যা বাংলাদেশের নিজস্ব কূটনৈতিক ভারসাম্যে প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশ চিনর সঙ্গে অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ নিচ্ছে, যা এই পরিস্থিতিতে একটি নতুন দ্বিধা তৈরি করতে পারে। তবে, ভারত-চিনর সম্পর্কের উন্নতি বাংলাদেশের জন্য একটি সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ উভয়ই হতে পারে, যা তাদের নেতৃবৃন্দকে সতর্ক করে তুলেছে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
এই সফরটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্প্রতি ৫০% ট্যারিফ আরোপণের পর, যা ভারত ও চীন উভয়ের উপর প্রয়োগ করা হয়েছে। পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকসের একটি ২০২৪-এর রিপোর্ট অনুসারে, এই ধরনের অর্থনৈতিক চাপ দুই দেশকে ব্যবহারিক সহযোগিতার দিকে ঠেলে নিতে পারে। ২০১৭-এর জার্নাল অফ কনফ্লিক্ট রেজোলিউশন-এর গবেষণা দেখায়, সীমান্তবিস্তারিত এলাকায় কূটনৈতিক আলোচনা সামরিক সংঘর্ষের ঝুঁকি ৩০% কমায়, যা এই সাক্ষাতের গুরুত্ব প্রমাণ করে।
সম্ভাব্য ফলাফল
ভারত-চিনর এই সাক্ষাতে সীমান্ত উদ্বেগ নিরসনে ফল দিতে পারে এবং SCO সম্মেলনে দুই দেশের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হতে পারে। তবে পাকিস্তানের জন্য এটি একটি সতর্কতার ঘণ্টা, যেখানে তারা চিনর সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন করতে বাধ্য হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, এই পরিবর্তন অর্থনৈতিক সুযোগের পাশাপাশি নতুন চ্যালেঞ্জও তৈরি করবে।
ওয়াং ই’র ভারত সফর দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্র পুনর্লিখন করতে পারে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জন্য এটি একটি কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ, যা তাদের নীতি পুনর্গঠনের দিকে ঠেলে নেবে। ভবিষ্যতের দিনগুলো দেখাবে, এই সফর কীভাবে এই অঞ্চলের ভারসাম্য রাখে।