বাংলাভাষী শ্রমিকদের ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে হেনস্থা ও আটক করা হচ্ছে—এমন গুরুতর অভিযোগ নিয়ে দায়ের হওয়া এক জনস্বার্থ মামলার শুনানি হল দেশের সর্বোচ্চ আদালতে (Supreme Court) । অভিযোগকারীদের দাবি, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষ করে সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে বহু বছরের বসবাসকারী ও আইনসম্মতভাবে কাজ করা বাংলাভাষী শ্রমিকদের শুধুমাত্র তাদের ভাষা ও চেহারার ভিত্তিতে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। এর ফলে তাঁদের অনেকে ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক রয়েছেন, আবার অনেককে চাকরি থেকে বিতাড়িত বা জোরপূর্বক বাড়ি ফেরার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে।
এই প্রেক্ষিতে কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও মানবাধিকার কর্মী যৌথভাবে সুপ্রিম কোর্টে (Supreme Court) জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন। তাঁদের দাবি, ডিটেনশন ক্যাম্পে যাদের রাখা হচ্ছে, তাঁদের অধিকাংশই ভারতীয় নাগরিক বা বহুদিনের স্থায়ী বাসিন্দা। শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে, পর্যাপ্ত প্রমাণ ছাড়াই তাঁদের মৌলিক অধিকার হরণ করা হচ্ছে। মামলা দায়েরকারীরা আদালতের কাছে আবেদন জানান, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ডিটেনশন ক্যাম্পে নতুন করে কাউকে পাঠানো যাবে না—এরকম একটি অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ জারি করতে।
আজ, বৃহস্পতিবার মামলার শুনানি হয় বিচারপতি সূর্য কান্ত ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর দ্বৈত বেঞ্চে। শুনানিতে মামলার পক্ষের আইনজীবীরা বলেন, এই ধরনের ‘প্রোফাইলিং’ ও ‘বর্ণবিদ্বেষমূলক হেনস্থা’ ভারতীয় সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী। তাঁরা যুক্তি দেন, ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন এবং ১৯৬১ সালের সীমান্ত সুরক্ষা আইন—উভয় ক্ষেত্রেই তদন্ত ও প্রমাণ ছাড়া কাউকে বিদেশি ঘোষণা করার কোনো বিধান নেই। কিন্তু বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না।
পক্ষের আইনজীবীরা আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যে, ডিটেনশন ক্যাম্পগুলির অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। সেখানে আটক ব্যক্তিদের জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসা, খাবার বা আইনি সহায়তার সুযোগ নেই। অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুমতিও দেওয়া হয় না। তাঁরা দাবি করেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে বহু নিরপরাধ ব্যক্তি বছরের পর বছর বিনা বিচারে বন্দি থাকবেন।
তবে, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাঁদের বক্তব্য, ডিটেনশন ক্যাম্পে শুধুমাত্র সেইসব ব্যক্তিকেই রাখা হয় যাঁদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে তাঁরা বৈধ নথি ছাড়া দেশে অবস্থান করছেন। পাশাপাশি তাঁরা জানান, প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্থানীয় প্রশাসন তদন্ত করে, নথি যাচাই করে এবং বিদেশি ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়।
সব পক্ষের বক্তব্য শোনার পর আদালত জানায়, এই মুহূর্তে ডিটেনশন ক্যাম্পের ওপর অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ জারি করা হবে না। বিচারপতি সূর্য কান্ত বলেন, “আমরা বিষয়টির গুরুত্ব বুঝি, কিন্তু প্রাথমিক স্তরে রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্যও শোনার প্রয়োজন রয়েছে। একতরফা স্থগিতাদেশ দিলে প্রশাসনিক কাজকর্মে জটিলতা তৈরি হতে পারে।”
তবে আদালত(Supreme Court) মামলাটি গ্রহণ করে বিস্তারিত শুনানির নির্দেশ দেয়। আগামী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হবে যেখানে ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা ব্যক্তিদের তালিকা, তাঁদের নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র, এবং আটক হওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কিত বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করতে হবে। আদালত আরও জানায়, এই রিপোর্টের ভিত্তিতেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এই রায়ের ফলে আপাতত ডিটেনশন ক্যাম্পের কার্যক্রমে কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না, যদিও মামলাটি জনস্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মানবাধিকার কর্মীদের একাংশের মতে, এই মামলার মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে ‘নাগরিকত্ব যাচাই প্রক্রিয়া’র স্বচ্ছতা ও বৈধতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠবে।
বাংলাভাষী শ্রমিকদের সংগঠনগুলির বক্তব্য, এই মামলার ফলাফলের উপরই নির্ভর করবে তাঁদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা। কারণ, একবার যদি আদালত এই ধরনের আটক প্রক্রিয়ায় অনিয়ম স্বীকার করে নেয়, তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধে চলতে থাকা ‘বাংলাদেশি’ তকমা লাগানোর প্রবণতা রোধ করা সম্ভব হবে।