ভারত সরকার সম্প্রতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ইউরিয়া সাবসিডিতে (Urea Subsidy) পরিবর্তনের ঘোষণা করেছে, যা দেশের কৃষক সম্প্রদায়ের জন্য উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে। সরকারের এই পদক্ষেপ কৃষি খরচ নিয়ন্ত্রণ, টেকসই কৃষি প্রচার এবং মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সারের জন্য মোট ১.৮৪ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যার মধ্যে ইউরিয়ার জন্য ১.১৯ লক্ষ কোটি টাকা এবং ফসফেটিক ও পটাশ (পি অ্যান্ড কে) সারের জন্য ০.৪৯ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এই বরাদ্দ গত বছরের তুলনায় কিছুটা কম হলেও, সরকারের লক্ষ্য হল কৃষকদের জন্য সারের দাম সাশ্রয়ী রাখা এবং টেকসই কৃষি পদ্ধতির প্রচার। এই প্রতিবেদনে আমরা ইউরিয়া সাবসিডির পরিবর্তন, কৃষি খরচের উপর এর প্রভাব এবং কৃষকদের জন্য এর অর্থ কী তা নিয়ে আলোচনা করব।
ইউরিয়া সাবসিডির পরিবর্তন
ইউরিয়া ভারতের কৃষি খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সার, যা ধান, গম এবং আখের মতো ফসলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে, এক বস্তা (৪৫ কেজি) ইউরিয়ার সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) ২৪২ টাকা, যদিও এর উৎপাদন খরচ ২,২০০ টাকারও বেশি। সরকার প্রতি বস্তায় প্রায় ১,৯৫০-২,০০০ টাকার সাবসিডি প্রদান করে, যা উৎপাদন খরচের প্রায় ৯০% কভার করে। এই বিশাল সাবসিডি কৃষকদের জন্য ইউরিয়ার দাম সাশ্রয়ী রাখে, তবে এটি মাটির স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অতিরিক্ত ইউরিয়া ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরতা হ্রাস, নাইট্রেট দূষণ এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরে, সরকার ইউরিয়া সাবসিডির পরিমাণ ১.১৯ লক্ষ কোটি টাকা রেখেছে, যা গত বছরের সঙ্গে তুলনীয়। তবে, সরকার ইউরিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার কমাতে এবং টেকসই কৃষি প্রচারের জন্য কিছু সংস্কার চালু করছে। এর মধ্যে রয়েছে ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার (ডিবিটি) সিস্টেমের মাধ্যমে সাবসিডি সরাসরি কৃষকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রদান করা। এই পদক্ষেপ কৃষকদের সচেতনতা বাড়াতে এবং ইউরিয়ার অপব্যবহার কমাতে সহায়ক হবে। এছাড়া, সরকার ন্যানো-ইউরিয়া এবং জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানোর উপর জোর দি���্ছে, যা কম পরিমাণে ব্যবহার করলেও উচ্চ দক্ষতা প্রদান করে।
কৃষি খরচের উপর প্রভাব
ইউরিয়া সাবসিডির সংস্কার কৃষকদের খরচের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে। বর্তমানে, ইউরিয়ার দাম কৃষকদের জন্য সাশ্রয়ী থাকলেও, সরকারের সংস্কার নীতি কৃষকদের আরও দক্ষতার সঙ্গে সার ব্যবহারে উৎসাহিত করবে। উদাহরণস্বরূপ, সয়েল হেলথ কার্ড প্রোগ্রামের সঙ্গে সাবসিডি সংযুক্ত করা হলে, কৃষকরা তাদের মাটির পুষ্টি স্থিতি সম্পর্কে সচেতন হবেন এবং সঠিক পরিমাণে সার ব্যবহার করবেন। এটি অতিরিক্ত সার ব্যবহার কমিয়ে মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করবে এবং দীর্ঘমেয়াদে কৃষি খরচ কমাতে সাহায্য করবে।
তবে, কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ভারত ইউরিয়ার জন্য ৩০% এবং ফসফেট ও পটাশের জন্য ৭০-১০০% আমদানির উপর নির্ভরশীল। বিশ্ববাজারে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বৃদ্ধি এবং সাপ্লাই চেইন ব্যাঘাতের কারণে সারের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে, সরকার সাবসিডি বাড়িয়ে কৃষকদের খরচ স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছে। উদাহরণস্বরূপ, যদি ইউরিয়ার বাজার মূল্য ৫,০০০ টাকা থেকে ৬,০০০ টাকা প্রতি টন বৃদ্ধি পায়, তবে সরকার সাবসিডি ৯০% থেকে ৯৫% বাড়িয়ে কৃষকদের খরচ স্থির রাখতে পারে।
টেকসই কৃষির দিকে অগ্রসর
সরকারের নতুন সংস্কার নীতি টেকসই কৃষির উপর জোর দিচ্ছে। ন্যানো-ইউরিয়া এবং জৈব সারের প্রচার কৃষকদের জন্য কম খরচে উচ্চ ফলন নিশ্চিত করবে। এছাড়া, ডিজিটাল কৃষি প্ল্যাটফর্ম এবং এআই-ভিত্তিক আবহাওয়া পূর্বাভাস কৃষকদের আরও সঠিকভাবে সার প্রয়োগ করতে সাহায্য করবে। এই পদক্ষেপগুলো কৃষি খরচ কমানোর পাশাপাশি পরিবেশের উপর সারের নেতিবাচক প্রভাব হ্রাস করবে। উদাহরণস্বরূপ, সঠিক সার ব্যবহার নাইট্রাস অক্সাইড নির্গমন ৩০% পর্যন্ত কমাতে পারে, যা ভারতের প্যারিস জলবায়ু চুক্তির প্রতিশ্রুতি পূরণে সহায়ক হবে।
কৃষকদের জন্য সুযোগ
ইউরিয়া সাবসিডির সংস্কার কৃষকদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করছে। সরকারের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং সয়েল হেলথ কার্ডের মাধ্যমে কৃষকরা তাদের ফসল এবং মাটির জন্য উপযুক্ত সারের পরিমাণ সম্পর্কে জানতে পারবেন। এছাড়া, জৈব সার এবং ন্যানো-ইউরিয়া ব্যবহারকারী কৃষকদের জন্য অতিরিক্ত সাবসিডি এবং পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকবে। এই পদক্ষেপগুলো কৃষকদের আর্থিক বোঝা কমাবে এবং তাদের আয় বাড়াতে সহায়ক হবে।
চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
ইউরিয়া সাবসিডির সংস্কারের পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ইউরিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে মাটির পুষ্টির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে ফসলের উৎপাদনশীলতা হ্রাস করতে পারে। এছাড়া, আমদানি নির্ভরতা এবং বিশ্ববাজারে দামের ওঠানামা কৃষকদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। তবে, সরকারের নতুন ইউরিয়া প্ল্যান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা, যেমন আসামের নামরূপে ১.২৭ মিলিয়ন টন ক্ষমতার প্ল্যান্ট, আমদানি নির্ভরতা কমাতে সহায়ক হবে।
ইউরিয়া সাবসিডির সংস্কার ভারতের কৃষি খাতে একটি নতুন দিশা দেখাচ্ছে। সরকারের এই পদক্ষেপ কৃষকদের জন্য সারের দাম সাশ্রয়ী রাখার পাশাপাশি টেকসই কৃষি প্রচার করবে। ন্যানো-ইউরিয়া, জৈব সার এবং ডিজিটাল কৃষির প্রচার কৃষকদের খরচ কমাবে এবং মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করবে। তবে, এই সংস্কারের সফলতা নির্ভর করবে কৃষকদের সচেতনতা বাড়ানো এবং তাদের নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে উৎসাহিত করার উপর। আগামী মরশুমে কৃষকরা এই সংস্কারের সুবিধা নিয়ে আরও উৎপাদনশীল এবং টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবেন।