নিজস্ব সংবাদদাতা, পশ্চিম মেদিনীপুর: ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র শহীদ ক্ষুদিরাম বসু। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বেছে নেওয়া এই তরুণ বিপ্লবী মাত্র আঠারো বছর বয়সেই প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন মাতৃভূমির জন্য। আজ ১১ই আগস্ট, তাঁর ১১৮ তম আত্মবলিদান দিবস (Martyrdom Anniversary of Khudiram Bose) শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর ১১৮ তম আত্মবলিদান দিবস পালিত জন্মভূমি মোহবনীতে) পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশপুর ব্লকের অন্তর্গত জন্মভূমি মোহবনীতে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হলো।
১৮৯৯ সালের ৩রা ডিসেম্বর অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার কেশপুরের মোহবনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ক্ষুদিরাম বসু। পিতা তৈলক্যনাথ বসু ও মাতা লক্ষীপ্রিয়া দেবীর কনিষ্ঠ সন্তান ক্ষুদিরাম ছোটবেলা থেকেই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। অল্প বয়সেই তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ব্রিটিশ জজ কিংসফোর্ডের হত্যার উদ্দেশ্যে মুজাফফরপুরে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় অভিযুক্ত হয়ে মাত্র ১৮ বছর বয়সে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন তিনি। ১৯০৮ সালের ১১ই আগস্ট ভোর পাঁচটায় বিহারের মুজাফফরপুর জেলে তাঁর ফাঁসি কার্যকর হয়।
স্বাধীনতার পর থেকে প্রতি বছর ১১ই আগস্ট তাঁর আত্মবলিদান দিবস সারা দেশে এবং বিশেষভাবে জন্মভূমি মোহবনীতে পালন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে বর্তমানে মোহবনীতে ‘ক্ষুদিরাম উন্নয়ন পর্ষদ’ গঠিত হয়েছে এবং প্রতিবছর এই দিনে সরকারি মর্যাদায় অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়।
এদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী শিউলি সাহা, মন্ত্রী শ্রীকান্ত মাহাতো, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জেলাশাসক খুরশেদ আলী কাদরী, জেলা তথ্য ও সাংস্কৃতিক আধিকারিক বরুণ মন্ডল, জেলা পরিষদের সভাধিপতি প্রতিভা মাইতি, সহ-সভাপতি অজিত মাইতি, কেশপুরের সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক কোশিষ রায় সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর মর্মরমূর্তিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে তাঁকে শ্রদ্ধা জানান অতিথিরা। মন্ত্রী শিউলি সাহা বলেন, “ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার জন্য কেশপুরের মোহবনীর ছোট্ট ছেলেটাই প্রথম আত্মবলিদান দিয়েছিলেন। সেখানকার একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমার কাছে বিষয়টি অত্যন্ত আবেগের। দেশের জন্য যিনি প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁর পূণ্যভূমিতে এসে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি।”
মন্ত্রী শ্রীকান্ত মাহাতো বলেন, “শহীদ ক্ষুদিরাম কেবল পশ্চিমবঙ্গ নয়, সারা দেশের গর্ব। তরুণ প্রজন্মকে তাঁর জীবন থেকে শিখতে হবে যে, দেশপ্রেম মানে ত্যাগ, সাহস এবং নিষ্ঠা।”
এদিনের অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মাধ্যমে ক্ষুদিরামের জীবন ও সংগ্রামের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। কবিতা পাঠ, দেশাত্মবোধক গান এবং নাট্যাংশে ভরে ওঠে মোহবনীর বাতাবরণ। স্থানীয় স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এই পরিবেশনায় উপস্থিত জনতা আবেগাপ্লুত হন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, এই ধরনের কর্মসূচি শুধু স্মৃতিচারণ নয়, বরং তরুণ সমাজের মধ্যে দেশপ্রেমের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার একটি কার্যকর মাধ্যম। প্রতিবছরের মতো এবারও কেশপুর প্রশাসনের সহযোগিতায় এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের উদ্যোগে অনুষ্ঠানটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়।
মোহবনী আজও শহীদ ক্ষুদিরামের ত্যাগের গর্ব বুকে ধারণ করে আছে। গ্রামের প্রবীণরা বলেন, “ক্ষুদিরামের জন্মভূমি হওয়ায় এই মাটি পবিত্র। তাঁর স্মৃতি আমাদের প্রজন্মের জন্য চিরন্তন প্রেরণা।”
এভাবে প্রতি বছর ১১ আগস্ট মোহবনী পরিণত হয় দেশপ্রেমের এক তীর্থক্ষেত্রে, যেখানে হাজারো মানুষ একত্রিত হয়ে স্মরণ করেন সেই আঠারো বছরের নির্ভীক বালককে, যিনি মৃত্যুকে তুচ্ছ জেনে মাতৃভূমির জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন।