ভারতের কৃষি খাতকে শক্তিশালী করতে এবং কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে মোদী সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে একাধিক নতুন প্রকল্প (New Farmer Schemes ) ঘোষণা করেছে। এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে কৃষকদের আর্থিক সহায়তা, সেচ ব্যবস্থার উন্নতি, আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ধান-ধান্য কৃষি যোজনা, কৃষক ক্রেডিট কার্ড (KCC) এর সংশোধিত সুদ সহায়তা প্রকল্প এবং জাতীয় উচ্চ ফলনশীল বীজ মিশনের মতো প্রকল্পগুলো কৃষকদের জন্য নতুন আশার আলো জ্বালিয়েছে। এই প্রকল্পগুলোর মূল সুবিধা, যোগ্যতা এবং আবেদন পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই প্রতিবেদনটি পড়ুন।
প্রধানমন্ত্রী ধান-ধান্য কৃষি যোজনা: কৃষি উৎপাদনশীলতার নতুন দিগন্ত
২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে শুরু হওয়া প্রধানমন্ত্রী ধান-ধান্য কৃষি যোজনা (PMDDKY) ছয় বছরের জন্য ঘোষিত হয়েছে, যা ১০০টি নিম্ন-উৎপাদনশীল জেলায় কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ১.৭ কোটি কৃষক উপকৃত হবেন। এর মূল উদ্দেশ্য হলো ফসলের বৈচিত্র্যকরণ, টেকসই কৃষি পদ্ধতি এবং পঞ্চায়েত ও ব্লক স্তরে পোস্ট-হার্ভেস্ট স্টোরেজ সুবিধা তৈরি করা। এছাড়া, দীর্ঘমেয়াদী এবং স্বল্পমেয়াদী কৃষি ঋণের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা হবে। প্রতি বছর এই প্রকল্পে ২৪,০০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে।
কিষাণ ক্রেডিট কার্ড (KCC): সাশ্রয়ী ঋণের নতুন সুযোগ
কৃষকদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে ঋণ প্রদানের জন্য মোদী সরকার কিষাণ ক্রেডিট কার্ড (KCC) প্রকল্পে সংশোধিত সুদ সহায়তা প্রকল্প (MISS) চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় কৃষকরা ৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদী ঋণ পাবেন ৭% সুদের হারে, যেখানে ১.৫% সুদ সহায়তা প্রদান করা হবে। সময়মতো ঋণ পরিশোধকারী কৃষকরা অতিরিক্ত ৩% সুদ ছাড় পাবেন, ফলে তাদের কার্যকর সুদের হার কমে দাঁড়াবে ৪%। পশুপালন এবং মৎস্য চাষের জন্য ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণে এই সুবিধা প্রযোজ্য। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য এই প্রকল্পে ১৫,৬৪২ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে ৭.৭৫ কোটিরও বেশি KCC অ্যাকাউন্ট রয়েছে, এবং এই প্রকল্প কৃষি ঋণের প্রবাহ বাড়িয়ে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
জাতীয় উচ্চ ফলনশীল বীজ মিশন: উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির নতুন পথ
২০২৫ সালে ঘোষিত জাতীয় উচ্চ ফলনশীল বীজ মিশনের লক্ষ্য হলো কৃষকদের জন্য উচ্চ ফলনশীল এবং কীটপতঙ্গ প্রতিরোধী বীজের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ১০০টিরও বেশি নতুন বীজ প্রকাশ করা হয়েছে। এই মিশনের মাধ্যমে বীজ গবেষণা জোরদার করা হবে এবং বাণিজ্যিক প্রাপ্যতা বাড়ানো হবে। এটি কৃষকদের ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এবং কীটপতঙ্গের কারণে ফসলের ক্ষতি কমাতে সহায়ক হবে।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প
১. আত্মনির্ভরতা ডাল মিশন: ছয় বছর মেয়াদি এই প্রকল্প তুর, উড়দ এবং মসুর ডালের উৎপাদন বাড়াতে কাজ করবে। জলবায়ু-প্রতিরোধী, উচ্চ প্রোটিনযুক্ত বীজ উন্নয়ন, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং নিশ্চিত ক্রয়ের ব্যবস্থা এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য।
২. শাকসবজি ও ফলের ব্যাপক প্রকল্প: ফসল উৎপাদন, সরবরাহ এবং কৃষকদের আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে এই প্রকল্পে রাজ্যগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে প্রক্রিয়াকরণ এবং বিপণনের সুবিধা প্রদান করা হবে।
৩. অ্যাগ্রি-টেক এমপাওয়ারমেন্ট প্রোগ্রাম (ATEP): এই প্রকল্প কৃষকদের জন্য ড্রোন, সেন্সর এবং এআই-ভিত্তিক সরঞ্জামের উপর ৫০% পর্যন্ত ভর্তুকি প্রদান করবে। ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং ডিজিটাল সরঞ্জামের ব্যবহার শেখানো হবে।
৪. জলবায়ু-প্রতিরোধী কৃষি উদ্যোগ (CRAI): জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এই প্রকল্প ড্রিপ সেচের মতো জল-দক্ষ পদ্ধতি এবং জলবায়ু-প্রতিরোধী ফসলের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করবে।
কীভাবে আবেদন করবেন?
কৃষকরা এই প্রকল্পগুলোর সুবিধা পেতে সরকারি পোর্টাল, স্থানীয় কৃষি অফিস বা কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র (KVK) এর মাধ্যমে আবেদন করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, PMDDKY এবং KCC-এর জন্য কৃষকরা https://pmkisan.gov.in বা https://kisanrin.digitalindia.gov.in পোর্টালে নিবন্ধন করতে পারেন। আবেদনের জন্য আধার কার্ড, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের বিবরণ, জমির দলিল এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে হবে। স্থানীয় কৃষি অফিস বা সমবায় সমিতিগুলো এই প্রক্রিয়ায় সহায়তা প্রদান করে।
যোগ্যতা
PMDDKY: নিম্ন-উৎপাদনশীল ১০০টি জেলার কৃষকরা এই প্রকল্পের জন্য যোগ্য। ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
KCC: কৃষি, পশুপালন বা মৎস্য চাষে নিযুক্ত নিবন্ধিত কৃষকরা আবেদন করতে পারেন।
ATEP এবং CRAI: ছোট ও প্রান্তিক কৃষক এবং জলবায়ু-সংবেদনশীল অঞ্চলের কৃষকরা এই প্রকল্পের জন্য অগ্রাধিকার পাবেন।
সুবিধা এবং প্রভাব
এই প্রকল্পগুলো কৃষকদের আয় বাড়ানো, ফসলের ক্ষতি কমানো এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই কৃষি প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। PMDDKY-এর মাধ্যমে পোস্ট-হার্ভেস্ট স্টোরেজ এবং সেচ ব্যবস্থার উন্নতি কৃষকদের আয় বাড়াবে। KCC-এর সাশ্রয়ী ঋণ কৃষকদের আর্থিক সংকট থেকে মুক্তি দেবে। ATEP এবং CRAI-এর মাধ্যমে কৃষকরা আধুনিক প্রযুক্তি এবং জলবায়ু-প্রতিরোধী ফসল চাষের সুবিধা পাবেন।
মোদী সরকারের এই নতুন প্রকল্পগুলো ভারতের কৃষি খাতে বিপ্লব ঘটাতে প্রস্তুত। কৃষকদের জন্য আর্থিক সহায়তা, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং টেকসই পদ্ধতির উপর জোর দিয়ে এই প্রকল্পগুলো কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে। কৃষকদের উচিত স্থানীয় কৃষি অফিস বা অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে এই প্রকল্পগুলোর সুবিধা নেওয়ার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আবেদন করা। এই প্রকল্পগুলো কেবল কৃষকদের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করবে না, বরং ভারতের কৃষি অর্থনীতিকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।