বিশ্ব সংস্কৃত দিবস উপলক্ষে ভারত ও ইরানের সাংস্কৃতিক সম্পর্কে এক নতুন মাত্রা যোগ করল তেহরান (Iran Praises Sanskri)। নয়াদিল্লিতে অবস্থিত ইরানের দূতাবাস সম্প্রতি তাদের সরকারি এক্স (পূর্বতন টুইটার) হ্যান্ডেল Iran_in_India-তে একটি পোস্ট শেয়ার করে সংস্কৃত ভাষাকে বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ভাষা হিসেবে সম্মান জানায়। শুধু ভাষাগত প্রশংসাই নয়, পোস্টে সংস্কৃত ও ইরানী ভাষাগুলির মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্কের কথাও বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়। এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসা কুড়ালেও ভারতের অভ্যন্তরে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
ইরানের পোস্টে লেখা হয়—
“আমরা বিশ্ব সংস্কৃত দিবসে বিশ্বের প্রাচীনতম ভাষাগুলির একটিকে সম্মান জানাই, যা ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি মূল স্তম্ভ। সংস্কৃত ও ইরানী ভাষার মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে—এটি ভারত ও ইরানের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের প্রতীক।”
পোস্টের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল একটি নান্দনিক চিত্র, যেখানে “মম ভব সুকৃতম” শিরোনামে প্রাচীন সংস্কৃত শ্লোকের উল্লেখ রয়েছে। এই চিত্রটি ভারতীয় জ্ঞান, দর্শন ও সংস্কৃতির প্রাচীন ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
প্রাচীন ভাষাগত যোগসূত্র
সংস্কৃত ও ইরানী ভাষার সম্পর্ক নিয়ে ভাষাবিদদের বিশ্লেষণ অত্যন্ত গভীর। উভয় ভাষাই প্রোটো-ইন্ডো-ইরানী ভাষা থেকে উদ্ভূত, যা আনুমানিক ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বে বিকশিত হয়। সংস্কৃতের ‘র্ত’ এবং আবেস্তান ভাষার ‘আশা’—দুটিই ন্যায় ও সত্যের ধারণা প্রকাশ করে। বেদ ও আবেস্তার মতো প্রাচীন গ্রন্থে অসংখ্য মিল পাওয়া যায়, যা এই ভাষাগত আত্মীয়তার প্রমাণ বহন করে। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন, বিশেষত বাক্ট্রিয়া-মার্গিয়ানা আর্কিওলজিকাল কমপ্লেক্স থেকে প্রাপ্ত তথ্য, ইন্ডো-আর্য ও ইরানী গোষ্ঠীর বিভাজনের ঐতিহাসিক ধাপগুলি স্পষ্ট করে।
সাংস্কৃতিক কূটনীতির সেতুবন্ধন
এই উদ্যোগ শুধু ভাষার প্রশংসা নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক কূটনীতি। ইরান ও ভারতের সম্পর্ক হাজার বছরের পুরনো—সিল্ক রোডের বাণিজ্য, মুঘল যুগের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান, কিংবা শিবাজি মহারাজের যুগের রাজনৈতিক সংযোগ—সবই এই সম্পর্কের সাক্ষী। আজকের দিনে যখন দুই দেশ ভিন্ন আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে রয়েছে, তখন সংস্কৃতের মতো একটি প্রাচীন ভাষাকে সামনে এনে ঐতিহাসিক বন্ধনের পুনর্জাগরণ ঘটানো নিঃসন্দেহে কৌশলগত।
ভারতে সংস্কৃতের বর্তমান অবস্থা
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি সংস্কৃত ভাষার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে একাধিক সরকারি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছেন। কেন্দ্রীয় সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, স্কুলে সংস্কৃত শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, প্রাচীন পুঁথি ও পান্ডুলিপি ডিজিটালাইজেশন—সব মিলিয়ে গত দশকে সংস্কৃত সংরক্ষণে একটি নতুন গতি এসেছে।
ইউনেস্কোর ২০২৩ সালের ভাষাগত বৈচিত্র্য রিপোর্ট বলছে, সংস্কৃত সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের ২০০-রও বেশি আধুনিক ভাষার বিকাশে প্রভাব রেখেছে।
বিতর্ক ও সমালোচনা
তবে এই প্রশংসার মাঝেও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। সমালোচকদের মতে, ভারতে সংস্কৃতকে প্রায়শই ‘হিন্দুত্বের প্রতীক’ হিসেবে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়, ফলে সাধারণ জনগণের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, বাস্তব জীবনে ও চাকরির বাজারে সংস্কৃতের ব্যবহার সীমিত হওয়ায় তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ কমছে। অথচ ভারতের বাইরে, বিশেষত ইরান, জাপান ও জার্মানির মতো দেশে, সংস্কৃত নিয়ে গবেষণা ও একাডেমিক আগ্রহ তুলনামূলক বেশি।
আন্তর্জাতিক সমর্থনের তাৎপর্য
ইরানের মতো একটি ইসলামিক রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সংস্কৃতের প্রশংসা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এটি প্রমাণ করে যে সংস্কৃত শুধু ধর্মীয় বা জাতীয়তাবাদী প্রতীক নয়, বরং একটি বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যা সীমান্ত পেরিয়ে মানবসভ্যতার যৌথ ইতিহাসকে বহন করে। এই পদক্ষেপ ভারতের জন্যও একটি বার্তা—নিজের ঐতিহ্যকে অবহেলা করলে অন্যরা তার গুরুত্ব তুলে ধরবে।
সব মিলিয়ে, বিশ্ব সংস্কৃত দিবসে ইরানের শুভেচ্ছা বার্তা শুধু একটি কূটনৈতিক সৌজন্য নয়, বরং ভারতের জন্য একটি স্মরণপত্র—সংস্কৃত কেবল অতীতের গর্ব নয়, ভবিষ্যতের সাংস্কৃতিক সেতুও হতে পারে। প্রশ্ন শুধু, ভারত কি এই ঐতিহ্যকে নিজের মতো করে পুনরুজ্জীবিত করবে, নাকি তা অন্যদের প্রশংসার ওপর নির্ভর করবে?