গোসাবায় গ্রেফতার খুলনার সিরাজুল: অনুপ্রবেশ থেকে শাহজাহানের ডেরায় দীর্ঘদিন লুকিয়ে থাকার কাহিনি
দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবন উপকূলের শান্ত গ্রাম তারানগর-রাধানগর। মাছ ধরা, কৃষি আর বনজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল মানুষের বসতি। কিন্তু এই শান্ত পল্লীতে সম্প্রতি আলোড়ন ফেলেছে এক গ্রেফতার। স্থানীয় সুন্দরবন কোস্টাল থানার পুলিশ গতকাল রাতে এখান থেকেই পাকড়াও করেছে বাংলাদেশের খুলনা জেলার বাসিন্দা সিরাজুল শেখকে, যিনি দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে ভারতে বসবাস করছিলেন।
অবৈধ প্রবেশের কাহিনি
তিন বছর আগে খুলনা থেকে এক পরিচিত আত্মীয়—প্রতিবেশী দাদার হাত ধরে গোপন চোরাপথে ভারতে প্রবেশ করে সিরাজুল। প্রথমে তিনি উত্তর ২৪ পরগনার বারাসাতে বেশ কিছুদিন গোপনে বসবাস করেন। কোনও বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাতেন। তারপর ভাগ্যের সন্ধানে চলে আসেন সন্দেশখালীর মালঞ্চ এলাকায়, যা একসময় কুখ্যাত তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহানের প্রভাববলয়ে ছিল।
শাহজাহানের ডেরায় দিন
মালঞ্চে এসে সিরাজুল একটি ইটভাটায় কাজ পেয়ে যায়। অভিযোগ, এখানে থাকাকালীন তিনি স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সান্নিধ্যে আসেন, যাদের অনেকেই শাহজাহানের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে ছিলেন। যদিও সরাসরি অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকার কথা তিনি অস্বীকার করেছেন, তবুও স্থানীয়দের একাংশের সন্দেহ, তার উপস্থিতি হয়তো কেবল শ্রমিকের সীমায় আবদ্ধ ছিল না।
শেখ শাহজাহান, যিনি বর্তমানে দেড় বছর ধরে জেলবন্দি, তাঁর বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ, জমি দখল, এমনকি অনুপ্রবেশকারীদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্মূল করার অভিযোগ রয়েছে। সূত্রের দাবি, কয়েক বছর আগে একাধিক বিজেপি নেতার ওপর হামলায় বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ব্যবহার করেছিল শাহজাহান। তাই প্রশ্ন উঠছে—সিরাজুল কি সেই ধরনের নেটওয়ার্কেরই অংশ ছিলেন? নাকি শুধুই কাজের সন্ধানে এসেছিলেন?
ব্যক্তিগত জীবনে গোপন আশ্রয়
মালঞ্চ থেকে কিছুদিন পর সিরাজুল চলে আসেন গোসাবা বিধানসভার তারানগর-রাধানগর এলাকায়। এখানে তিনি একটি ‘শ্বশুরবাড়ির সম্পর্ক’ গড়ে তোলেন—অর্থাৎ এক স্থানীয় মেয়েকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর থেকে তিনি গ্রামে সম্পূর্ণভাবে মিশে গিয়েছিলেন। গ্রামবাসীদের অনেকেই জানতেন না যে তিনি বাংলাদেশের নাগরিক।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সিরাজুল প্রায়শই নদীতে মাছ ধরতে যেতেন, মাঝে মাঝে কৃষিকাজও করতেন। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রামে তেমন কোনও বিরূপ মন্তব্য ছিল না, তবে কিছু মানুষ মনে করতেন, তিনি অতিরিক্ত গোপনীয় আচরণ করেন এবং নিজের অতীত নিয়ে খুব কম কথা বলেন।
গ্রেফতার ও তদন্ত
পুলিশ সূত্রে খবর, গোসাবা থানায় গোপন সূত্রে খবর আসে যে, রাধানগরে এক বাংলাদেশি নাগরিক বৈধ নথি ছাড়াই বসবাস করছে। এরপর গতকাল রাতে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ধৃতের কাছ থেকে কোনও রকম পাসপোর্ট, ভিসা বা ভারত সরকারের অনুমোদিত পরিচয়পত্র পাওয়া যায়নি।
পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে সিরাজুল স্বীকার করেছেন যে তাঁর বাড়ি বাংলাদেশের খুলনা জেলায়। যাঁর সাহায্যে তিনি ভারতে এসেছিলেন, সেই আত্মীয় এখনও ভারতে রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন, তবে তাঁর সঠিক অবস্থান জানেন না। সিরাজুলের কথায়, দীর্ঘদিন ধরেই তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ নেই।
অনুপ্রবেশের বড় ছবি
বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশের ঘটনা নতুন নয়। বিশেষত সীমান্তবর্তী উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এই প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে। তবে উদ্বেগের বিষয়, এই অনুপ্রবেশ কেবল অর্থনৈতিক কারণে নয়—রাজনৈতিক অপরাধ, চোরাচালান, এমনকি অপরাধচক্রের বিস্তারে এই বিদেশিদের ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ।
শেখ শাহজাহানের নাম এ ক্ষেত্রে বারবার উঠে আসে। সন্দেশখালীর কুখ্যাত এই নেতা অতীতে বহু অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত। তাঁর ডেরায় বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের উপস্থিতি একাধিকবার ধরা পড়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, সিরাজুলের মতো শ্রমিকদের মাধ্যমে প্রথমে একটি নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করা হয়, তারপর প্রয়োজনে তাদের অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা হয়।
প্রশাসনের ভূমিকা
পুলিশ ইতিমধ্যেই সিরাজুলের অনুপ্রবেশপথ, তার সম্ভাব্য সহযোগী, এবং অতীতে কোনও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন কি না, তা খতিয়ে দেখছে। তাঁর সঙ্গে সন্দেশখালীর পুরনো অপরাধী চক্র বা শাহজাহানের ঘনিষ্ঠদের কোনও যোগ আছে কি না, সেটিও তদন্তের আওতায় এসেছে।
গোসাবা থানা সূত্রে জানানো হয়েছে, ধৃতকে আদালতে পেশ করা হবে এবং ফরেনার্স অ্যাক্ট অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে তার ভারতে প্রবেশে সহায়তাকারীদের খোঁজে তল্লাশি চলছে।