পশ্চিমবঙ্গ ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হলেও, এই খাতে দক্ষতার ঘাটতি (IT Skill Gap Crisis) একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজ্যে প্রতি বছর হাজার হাজার ইঞ্জিনিয়ারিং এবং আইটি-সংক্রান্ত গ্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে, কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র ৪৮.৫% নিয়োগের যোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছে, যা জাতীয় গড় ৪২.৬% থেকে সামান্য বেশি। এই দক্ষতার ঘাটতি শুধুমাত্র নতুন গ্র্যাজুয়েটদের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাকেই প্রভাবিত করছে না, বরং পশ্চিমবঙ্গের আইটি শিল্পের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকেও প্রশ্নের মুখে ফেলছে। এই প্রতিবেদনে আমরা পশ্চিমবঙ্গের আইটি শিল্পে দক্ষতার ঘাটতির কারণ এবং কলেজগুলির ভূমিকা বিশ্লেষণ করব।
দক্ষতার ঘাটতির মূল কারণ
পশ্চিমবঙ্গে আইটি শিল্পে দক্ষতার ঘাটতির প্রধান কারণ হল শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে শিল্পের চাহিদার মধ্যে অমিল। ভারতের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও তাত্ত্বিক জ্ঞানের উপর বেশি নির্ভরশীল, যেখানে ব্যবহারিক দক্ষতা এবং শিল্প-নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণের উপর পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ২০২৩ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে মাত্র ৫.৫% বেসিক প্রোগ্রামিং দক্ষতা রাখে। এই সমস্যা পশ্চিমবঙ্গেও প্রকট, যেখানে কলেজগুলির পাঠ্যক্রম প্রায় এক দশক পুরনো এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), মেশিন লার্নিং, সাইবারসিকিউরিটি এবং ডেটা অ্যানালিটিক্সের মতো নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
একটি সিআইআই-পিডব্লিউসি স্কিল গ্যাপ স্টাডি অনুযায়ী, ২০১৫ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে আইটি এবং আইটিইএস খাতে ১,১৫,০০০ থেকে ১,২০,০০০ দক্ষ কর্মীর ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। এই ঘাটতি এখনও অব্যাহত রয়েছে, কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী পাঠ্যক্রম আপডেট করতে ব্যর্থ হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, কলকাতার অনেক কলেজে এখনও পুরনো প্রোগ্রামিং ভাষা যেমন সি++ বা জাভার উপর জোর দেওয়া হয়, যখন শিল্পে পাইথন, আর, এবং ক্লাউড কম্পিউটিং-এর মতো দক্ষতার চাহিদা বাড়ছে।
কলেজগুলির ব্যর্থতা
পশ্চিমবঙ্গের আইটি শিক্ষা ব্যবস্থা দক্ষতার ঘাটতির জন্য অনেকাংশে দায়ী। রাজ্যে ২০৪টি আইটি কলেজ রয়েছে, যার মধ্যে ১৫৪টি বেসরকারি এবং ১৮টি সরকারি। তবে, এই কলেজগুলির পাঠ্যক্রমে শিল্প-নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ, ইন্টার্নশিপ এবং হ্যান্ডস-অন প্রোজেক্টের অভাব রয়েছে। মার্সার মেটল রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে গ্র্যাজুয়েটদের নিয়োগযোগ্যতার হার ৪৯.২%, যা দিল্লি (৫৩.৪%) এবং পাঞ্জাব (৫১.১%) এর তুলনায় কম। এই প্রতিবেদনটি আরও উল্লেখ করে যে, টিয়ার ২ এবং টিয়ার ৩ কলেজগুলির গ্র্যাজুয়েটরা টেকনিক্যাল এবং নন-টেকনিক্যাল উভয় দক্ষতায় দুর্বল, যা তাদের নিয়োগের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
অনেক কলেজে শিক্ষকদের মধ্যে শিল্প-নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে, এবং মাত্র ৪৭% ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র শিল্প সম্পর্কিত আলোচনায় অংশ নেয়। এছাড়া, ইন্টার্নশিপ এবং ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের সুযোগ সীমিত, যা গ্র্যাজুয়েটদের শিল্পের জন্য প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হয়। উদাহরণস্বরূপ, কলকাতার একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি কলেজের ছাত্ররা জানিয়েছেন যে তাদের পাঠ্যক্রমে ক্লাউড কম্পিউটিং বা সাইবারসিকিউরিটির মতো নতুন প্রযুক্তি শেখানো হয় না, যা আইটি কোম্পানিগুলিতে চাকরির জন্য অপরিহার্য।
শিল্পের চাহিদা এবং বাস্তবতা
পশ্চিমবঙ্গের আইটি শিল্পে কোম্পানিগুলি যেমন টিসিএস, ইনফোসিস, এবং উইপ্রো প্রতি বছর হাজার হাজার নতুন কর্মী নিয়োগ করে। তবে, ২০২৬ সালের মধ্যে ভারতে ১৪-১৯ লক্ষ দক্ষ আইটি পেশাদারের ঘাটতি দেখা দেবে বলে নাসকম-জিনোভ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এই ঘাটতি আরও তীব্র, কারণ কোম্পানিগুলি এমন প্রার্থী চায় যারা শুধুমাত্র প্রোগ্রামিং জানে না, বরং যোগাযোগ, সমস্যা সমাধান এবং টিমওয়ার্কের মতো নন-টেকনিক্যাল দক্ষতাও রাখে।
নাসকমের ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের আইটি শিল্প ২০২২ সালে ২২৭ বিলিয়ন ডলারের রাজস্ব অর্জন করেছে, এবং এই খাতে ৫০ লক্ষ কর্মী নিয়োজিত রয়েছে। তবে, দ্রুত প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কারণে, যেমন এআই, ব্লকচেইন, এবং ডেটা অ্যানালিটিক্স, শিল্পের চাহিদা ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের কলেজগুলি এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ হচ্ছে, যার ফলে নতুন গ্র্যাজুয়েটরা প্রায়শই “অন-দ্য-জব ট্রেনিং” এর উপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়।
সমাধানের পথ
পশ্চিমবঙ্গে দক্ষতার ঘাটতি মোকাবিলায় একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রথমত, কলেজগুলিকে শিল্পের সঙ্গে সহযোগিতা করে পাঠ্যক্রম আপডেট করতে হবে। এআই, মেশিন লার্নিং, এবং সাইবারসিকিউরিটির মতো বিষয়গুলি পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। দ্বিতীয়ত, ইন্টার্নশিপ এবং হ্যান্ডস-অন প্রোজেক্টের মাধ্যমে ছাত্রদের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা প্রদান করা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, জাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইইএম কলকাতার মতো প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে শিল্প-নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম শুরু করেছে, যা অন্যান্য কলেজের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।
তৃতীয়ত, এডটেক প্ল্যাটফর্ম যেমন কোর্সেরা, উডাসিটি, এবং স্প্রিংবোর্ড কৃষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এই প্ল্যাটফর্মগুলি সাশ্রয়ী মূল্যে শিল্প-নির্দিষ্ট কোর্স অফার করে, যা ছাত্রদের নতুন প্রযুক্তি শিখতে সহায়তা করে। এছাড়া, সরকারের প্রধানমন্ত্রী কৌশল বিকাশ যোজনা (পিএমকেভিওয়াই) এবং ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এনএসডিসি) এর মতো উদ্যোগগুলি পশ্চিমবঙ্গে আরও জোরদার করা প্রয়োজন। এই প্রোগ্রামগুলি কৃষকদের এবং তরুণ পেশাদারদের রিস্কিলিং এবং আপস্কিলিংয়ের সুযোগ প্রদান করছে।
পশ্চিমবঙ্গে সম্ভাবনা
পশ্চিমবঙ্গে আইটি শিল্পের সম্ভাবনা অপার। কলকাতা, শিলিগুড়ি, এবং দুর্গাপুরের মতো শহরগুলি আইটি হাব হিসেবে উঠে আসছে। তবে, এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার প্রয়োজন। শিল্পের সঙ্গে সহযোগিতা, ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধি, এবং ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের উপর জোর দেওয়া জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, রাজ্যের টিয়ার ২ এবং টিয়ার ৩ কলেজগুলির গ্র্যাজুয়েটরা তুলনামূলকভাবে ভালো দক্ষতা প্রদর্শন করছে, যা নির্দেশ করে যে সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারা শিল্পের চাহিদা পূরণ করতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গের আইটি শিল্পে দক্ষতার ঘাটতি একটি গুরুতর সমস্যা, যা কলেজগুলির পুরনো পাঠ্যক্রম এবং ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের অভাবের কারণে আরও জটিল হয়ে উঠছে। তবে, শিল্প-শিক্ষা সহযোগিতা, এডটেক প্ল্যাটফর্ম, এবং সরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গের তরুণদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এবং রাজ্যকে ভারতের আইটি হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে, শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ এবং দক্ষতা উন্নয়নের উপর জোর দেওয়া জরুরি। এই পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা গেলে, পশ্চিমবঙ্গের নতুন গ্র্যাজুয়েটরা শুধুমাত্র নিয়োগযোগ্যই হবে না, বরং ভারতের ডিজিটাল অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হবে।