ভারতের কৃষি খাতে ডিজিটাল বিপ্লব দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI farming), ড্রোন, ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি) এবং নির্ভুল কৃষি প্রযুক্তির মাধ্যমে স্মার্ট ফার্মিং (Smart Farming) ভারতীয় কৃষকদের উৎপাদনশীলতা এবং লাভজনকতা বাড়াচ্ছে। তবে, এই প্রযুক্তির গ্রহণ সারা দেশে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। কিছু রাজ্য অন্যদের তুলনায় দ্রুত স্মার্ট ফার্মিং গ্রহণ করছে, যা কৃষি উৎপাদন এবং কৃষকদের আয় বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই প্রতিবেদনে আমরা ভারতের শীর্ষ পাঁচটি রাজ্যের কথা উল্লেখ করব যারা ২০২৫ সালে স্মার্ট ফার্মিং গ্রহণে এগিয়ে রয়েছে এবং পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান বিশ্লেষণ করব।
১. কর্ণাটক: ডিজিটাল কৃষির পথপ্রদর্শক
কর্ণাটক ভারতের স্মার্ট ফার্মিং গ্রহণে শীর্ষে রয়েছে। বেঙ্গালুরু-কেন্দ্রিক অ্যাগ্রিটেক স্টার্টআপগুলি, যেমন ক্রপিন টেকনোলজি এবং ফার্মোনট, এআই-চালিত সমাধান এবং স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ফসল পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কৃষকদের ক্ষমতায়ন করছে। রাজ্যে নির্ভুল কৃষির ব্যবহার উচ্চ-মূল্যের ফসল, যেমন ফল, শাকসবজি এবং মশলা উৎপাদনে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্ণাটকের কোলারের মতো অঞ্চলে কৃষকরা ডিজিটাল মূল্য তথ্য সিস্টেমের মাধ্যমে বাজারের সেরা দাম পাচ্ছেন। রাজ্য সরকারের ডিজিটাল কৃষি উদ্যোগ এবং উচ্চ ইন্টারনেট প্রবেশ (৭০% এর বেশি) এই অগ্রগতির পেছনে মূল চালিকাশক্তি।
২. তেলেঙ্গানা: এআই এবং ড্রোনের কেন্দ্র
তেলেঙ্গানা স্মার্ট ফার্মিং গ্রহণে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। সাগু বাগু প্রকল্পের মতো উদ্যোগের মাধ্যমে, রাজ্যটি এআই-চালিত মাটি পরীক্ষা এবং ফসল ব্যবস্থাপনা প্রচার করছে, যা ৭,০০০ কৃষকের আয় দ্বিগুণ করেছে। হায়দ্রাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মিলেট রিসার্চ স্মার্ট ফার্মিং প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। তেলেঙ্গানায় ড্রোন-ভিত্তিক কীটনাশক স্প্রে এবং ফসল পর্যবেক্ষণ কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, যা শ্রম খরচ ২০% পর্যন্ত কমিয়েছে। রাজ্যের শক্তিশালী ডিজিটাল অবকাঠামো এবং সরকারি ভর্তুকি এই প্রযুক্তির গ্রহণকে ত্বরান্বিত করেছে।

৩. পাঞ্জাব: যান্ত্রিকীকরণ এবং স্মার্ট প্রযুক্তির সমন্বয়
পাঞ্জাব, যা ভারতের শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত, স্মার্ট ফার্মিংয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে। রাজ্যটি যান্ত্রিকীকরণে ৮০% এর বেশি গ্রহণ হারের জন্য পরিচিত, তবে এখন এআই-চালিত সেন্সর এবং জিপিএস-নির্দেশিত ট্রাক্টর ব্যবহার করছে। লেজার ল্যান্ড লেভেলিং (এলএলএল) এবং মাইক্রো-ইরিগেশন প্রযুক্তি ধান-গম চাষে জলের ব্যবহার ২০% কমিয়েছে। পাঞ্জাবের কৃষকরা ফার্মোনট এবং নেটাফিম-এর মতো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে রিয়েল-টাইম ফসল পর্যবেক্ষণ এবং স্মার্ট সেচ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। রাজ্যের বড় জমির মালিকানা এবং উন্নত অবকাঠামো এই প্রযুক্তির দ্রুত গ্রহণে সহায়তা করেছে।
৪. হরিয়ানা: নির্ভুল কৃষির অগ্রগতি
হরিয়ানা স্মার্ট ফার্মিংয়ে পাঞ্জাবের নিকটবর্তী প্রতিযোগী। রাজ্যটি নির্ভুল কৃষি প্রযুক্তি, বিশেষ করে মাইক্রো-ইরিগেশন এবং জিপিএস-চালিত যন্ত্রপাতি, ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছে। এলএলএল প্রযুক্তি ধান-গম চাষে বিদ্যুৎ খরচ প্রতি হেক্টরে ৭৫৫ কিলোওয়াট ঘণ্টা কমিয়েছে। হরিয়ানার কৃষকরা এআই-চালিত অ্যাপ যেমন প্ল্যান্টিক্স ব্যবহার করে ফসলের রোগ শনাক্ত করছে, যা ফসলের ক্ষতি ১৫% পর্যন্ত কমিয়েছে। রাজ্যের উচ্চ টেলি-ডেনসিটি (৮০%) এবং সরকারি উদ্যোগ, যেমন ডিজিটাল এগ্রিকালচার মিশন, এই অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছে।
৫. তামিলনাড়ু: ড্রোন এবং স্মার্ট সেচের উত্থান
তামিলনাড়ু স্মার্ট ফার্মিংয়ে পঞ্চম স্থানে রয়েছে, বিশেষ করে এর চা বাগান এবং ধানক্ষেত্রে ড্রোন প্রযুক্তি এবং স্মার্ট সেচ ব্যবস্থার জন্য। ফিউজলেজ ইনোভেশনস এর মতো স্টার্টআপগুলি ড্রোন-ভিত্তিক কীটনাশক স্প্রে এবং ফসল পর্যবেক্ষণ প্রচার করছে, যা শ্রম খরচ ৩০% পর্যন্ত কমিয়েছে। রাজ্যের নেটাফিম-এর গ্রোস্ফিয়ার প্ল্যাটফর্ম কৃষকদের রিয়েল-টাইম সেচ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করছে, যা জলের ব্যবহার ৫০% পর্যন্ত কমিয়েছে। তামিলনাড়ুর উন্নত ডিজিটাল অবকাঠামো এবং অ্যাগ্রিটেক স্টার্টআপগুলির উপস্থিতি এই প্রযুক্তির গ্রহণকে ত্বরান্বিত করেছে।

পশ্চিমবঙ্গ: কোথায় দাঁড়িয়ে?
পশ্চিমবঙ্গ স্মার্ট ফার্মিং গ্রহণে শীর্ষ পাঁচ রাজ্যের তালিকায় স্থান পায়নি, তবে এটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখাচ্ছে। রাজ্যের কৃষকরা ধীরে ধীরে এআই-চালিত চ্যাটবট এবং ড্রোন প্রযুক্তি গ্রহণ করছে। ফার্মোনট এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলি পশ্চিমবঙ্গের ধান এবং সবজি চাষিদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, যা ফসল পর্যবেক্ষণ এবং বাজার মূল্য তথ্য প্রদান করে। রাজ্যের কৃষি বিভাগ কিষাণ ই-মিত্রা চ্যাটবটের মাধ্যমে কৃষকদের সরকারি প্রকল্প এবং ফসল ব্যবস্থাপনা পরামর্শ প্রদান করছে। তবে, পশ্চিমবঙ্গে ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব এবং গ্রামীণ ইন্টারনেট সংযোগের সীমাবদ্ধতা (টেলি-ডেনসিটি ৫৯.১৯%) প্রযুক্তির গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করছে।
পশ্চিমবঙ্গে ছোট জমির মালিকানা এবং খণ্ডিত কৃষিজমির কারণে ড্রোন এবং নির্ভুল কৃষি প্রযুক্তির ব্যয়বহুল সরঞ্জাম ব্যবহার করা অনেক কৃষকের জন্য চ্যালেঞ্জিং। তবে, সরকারি উদ্যোগ যেমন ড্রোন শক্তি স্কিম এবং ডিজিটাল এগ্রিকালচার মিশন কৃষকদের জন্য ভর্তুকি এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। উদাহরণস্বরূপ, নদীয়া এবং মুর্শিদাবাদের কৃষকরা ড্রোন-ভিত্তিক ফসল পর্যবেক্ষণ এবং স্প্রে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করেছে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি, যেমন বিশ্বভারতী, কৃষকদের ডিজিটাল সাক্ষরতা এবং প্রযুক্তি প্রশিক্ষণে সহায়তা করছে। তবে, কর্ণাটক বা তেলেঙ্গানার তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে স্মার্ট ফার্মিং গ্রহণ এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
শীর্ষ পাঁচ রাজ্যে স্মার্ট ফার্মিংয়ের দ্রুত গ্রহণের পেছনে শক্তিশালী ডিজিটাল অবকাঠামো, সরকারি সমর্থন এবং অ্যাগ্রিটেক স্টার্টআপগুলির উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলি ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব, অপর্যাপ্ত ইন্টারনেট সংযোগ এবং উচ্চ প্রাথমিক খরচের কারণে পিছিয়ে রয়েছে। সরকারের ডিজিটাল এগ্রিকালচার মিশন এবং ই-ন্যাম প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কৃষকদের বাজার সংযোগ এবং প্রযুক্তি অ্যাক্সেস বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে।
২০২৫ সালের ইউনিয়ন বাজেটে ড্রোন ক্রয় এবং এআই-চালিত সমাধানের জন্য ভর্তুকি বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে, যা পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলির জন্য সুযোগ তৈরি করবে। অ্যাগ্রিটেক স্টার্টআপগুলি, যেমন জুয়ারি ফার্মহাব এবং ক্রপএক্স টেকনোলজিস, রিয়েল-টাইম মনিটরিং এবং ডিজিটাল সমাধান প্রদান করে কৃষকদের সহায়তা করছে। পশ্চিমবঙ্গে কৃষক সমবায় এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মাধ্যমে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি জোরদার করা গেলে স্মার্ট ফার্মিংয়ের গ্রহণ বাড়তে পারে।
কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা, পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং তামিলনাড়ু ভারতের স্মার্ট ফার্মিং গ্রহণে নেতৃত্ব দিচ্ছে, যা তাদের শক্তিশালী ডিজিটাল অবকাঠামো এবং সরকারি সমর্থনের ফল। পশ্চিমবঙ্গ, যদিও অগ্রগতি দেখাচ্ছে, তবুও ডিজিটাল সাক্ষরতা এবং অবকাঠামোর ঘাটতির কারণে পিছিয়ে রয়েছে। সরকারি উদ্যোগ, অ্যাগ্রিটেক স্টার্টআপ এবং কৃষকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ শীঘ্রই স্মার্ট ফার্মিংয়ের মূলধারায় যোগ দিতে পারে, যা রাজ্যের কৃষি খাতকে আরও টেকসই এবং লাভজনক করে তুলবে।