কৃষিতে এআই বিপ্লব! চ্যাটবট ও ড্রোন কীভাবে ফসলের উৎপাদন বাড়াচ্ছে

ভারতীয় কৃষি খাত বর্তমানে একটি নীরব বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI Revolution), চ্যাটবট এবং ড্রোন প্রযুক্তি কৃষকদের জন্য গেম-চেঞ্জার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।…

AI Revolution in Indian Agriculture: How Chatbots and Drones Boost Crop Yields in 2025

ভারতীয় কৃষি খাত বর্তমানে একটি নীরব বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI Revolution), চ্যাটবট এবং ড্রোন প্রযুক্তি কৃষকদের জন্য গেম-চেঞ্জার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, পোকামাকড়ের আক্রমণ, জলের অভাব এবং শ্রমশক্তির ঘাটতির মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভারতীয় কৃষকরা এখন এআই-চালিত চ্যাটবট এবং ড্রোনের উপর নির্ভর করছেন। এই প্রযুক্তিগুলি ফসলের উৎপাদন বাড়ানো, সম্পদের ব্যবহার অপ্টিমাইজ করা এবং টেকসই কৃষি প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০২৫ সালে, ভারতের কৃষি খাতে এআই এবং ড্রোন প্রযুক্তির ব্যবহার কীভাবে কৃষকদের আয় বাড়াচ্ছে এবং ফসলের ক্ষতি কমাচ্ছে, তা নিয়ে এই প্রতিবেদন।

এআই চ্যাটবট: কৃষকদের ডিজিটাল সহায়ক
এআই-চালিত চ্যাটবটগুলি ভারতীয় কৃষকদের জন্য তথ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষি মন্ত্রণালয়ের কিষাণ ই-মিত্রা চ্যাটবট কৃষকদের বিভিন্ন ভাষায় সরকারি প্রকল্প, যেমন পিএম কিষাণ সম্মান নিধি, সম্পর্কিত তথ্য প্রদান করে। এই চ্যাটবট কৃষকদের ফসল ব্যবস্থাপনা, বীজ নির্বাচন, সেচ এবং কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত পরামর্শ দেয়। তেলেঙ্গানার খাম্মাম জেলায় সাগু বাগু প্রকল্পে এআই চ্যাটবট ব্যবহার করে ৭,০০০ কৃষকের ফসলের উৎপাদন ২১% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তাদের আয় দ্বিগুণ হয়েছে। এই প্রকল্পটি এআই-চালিত মাটি পরীক্ষা, ফসলের গুণমান মূল্যায়ন এবং ডিজিটাল মার্কেটপ্লেসের মাধ্যমে কৃষকদের সরাসরি ক্রেতাদের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে।

   

চ্যাটবটগুলি কৃষকদের স্থানীয় আবহাওয়ার পূর্বাভাস, বাজার মূল্য এবং ফসলের রোগ সম্পর্কিত তথ্য প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ, প্ল্যান্টিক্স অ্যাপটি কৃষকদের ফসলের পাতার ছবি স্ক্যান করে রোগ শনাক্ত করতে এবং চিকিৎসার পরামর্শ দিতে সহায়তা করে। এই অ্যাপটি ১৮টি ভারতীয় ভাষায় উপলব্ধ এবং এটি কৃষকদের মধ্যে রোগ বা পোকামাকড়ের বিস্তার সম্পর্কে সতর্কতা পাঠায়, যা ফসলের ক্ষতি প্রতিরোধে সহায়ক। এই ধরনের প্রযুক্তি কৃষকদের সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম করে, যা উৎপাদনশীলতা বাড়ায় এবং খরচ কমায়।

ড্রোন প্রযুক্তি: নির্ভুল কৃষির নতুন দিগন্ত
ড্রোন প্রযুক্তি ভারতীয় কৃষিতে নির্ভুল কৃষি (প্রিসিশন ফার্মিং) প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এআই-চালিত ড্রোনগুলি মাল্টিস্পেকট্রাল এবং হাইপারস্পেকট্রাল ক্যামেরা দিয়ে সজ্জিত, যা ফসলের স্বাস্থ্য, মাটির আর্দ্রতা এবং পুষ্টির ঘাটতি শনাক্ত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কেরালার ধানক্ষেত্রে এবং তামিলনাড়ুর চা বাগানে ফিউজলেজ ইনোভেশনস নামক স্টার্টআপের ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে, যা কীটনাশক এবং সার স্প্রে করার জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা নজল ব্যবহার করে। এই ড্রোনগুলি ফসলের শোষণ হারের উপর ভিত্তি করে সঠিক পরিমাণে সার প্রয়োগ করে, যা অপচয় কমায় এবং পরিবেশের উপর প্রভাব হ্রাস করে।

ভারত সরকারের ড্রোন শক্তি স্কিম এবং কৃষি ড্রোন ক্রয়ের জন্য ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে কৃষকদের এই প্রযুক্তি গ্রহণে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ২০২৫ সাল পর্যন্ত, সরকার ২,৬২২টি ড্রোন বিতরণ করেছে, যা কৃষকদের জন্য ফসল পর্যবেক্ষণ এবং কীটনাশক স্প্রে করা সহজ করেছে। লেহের নামক একটি স্টার্টআপের ড্রোনগুলি প্রতিদিন ৫০ একর জমি কভার করতে পারে এবং এক একরে ১০ মিনিটেরও কম সময়ে স্প্রে সম্পন্ন করে, যা শ্রম এবং সময় বাঁচায়। এই ড্রোনগুলি ফসলের ঘনত্বের উপর ভিত্তি করে স্প্রে পরিমাণ সামঞ্জস্য করে, যা কীটনাশক এবং সারের ব্যবহার ২০% পর্যন্ত কমিয়ে দেয়।

এআই এবং ড্রোনের সমন্বয়: কৃষিতে নতুন সম্ভাবনা
এআই এবং ড্রোনের সমন্বয় ভারতীয় কৃষিতে একটি নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এআই অ্যালগরিদম স্যাটেলাইট চিত্র, ড্রোন ডেটা এবং মাটির সেন্সর থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে ফসলের স্বাস্থ্য, আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং কীটপতঙ্গের ঝুঁকি সম্পর্কে রিয়েল-টাইম তথ্য প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ, ফসল নামক একটি অ্যাগ্রিটেক প্ল্যাটফর্ম ৭৫,০০০ একর জমিতে স্মার্ট সেচ ব্যবস্থা প্রয়োগ করেছে, যা ৮০ বিলিয়ন লিটার জল সংরক্ষণ করেছে। এই প্রযুক্তি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় এবং জলের ব্যবহার কমাতে সহায়ক।

Advertisements

এছাড়া, এআই-চালিত ন্যাশনাল পেস্ট সার্ভেলান্স সিস্টেম কৃষকদের পোকামাকড়ের আক্রমণ শনাক্ত করতে এবং সময়মতো ব্যবস্থা নিতে সহায়তা করে। এই সিস্টেমটি মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে ধান এবং গমের মতো ফসলের রোগ শনাক্ত করে, যেমন হলুদ মরিচা, ৯৫% নির্ভুলতার সঙ্গে। এই ধরনের প্রযুক্তি কৃষকদের কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার কমাতে এবং পরিবেশ-বান্ধব কৃষি প্রচারে সহায়তা করে।

চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
যদিও এআই এবং ড্রোন প্রযুক্তি ভারতীয় কৃষিতে বিপ্লব ঘটাচ্ছে, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। ছোট এবং প্রান্তিক কৃষকদের জন্য ড্রোন এবং সেন্সরের উচ্চ প্রাথমিক খরচ একটি বড় বাধা। এছাড়া, ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব এবং গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগের সীমাবদ্ধতা প্রযুক্তির গ্রহণযোগ্যতাকে বাধাগ্রস্ত করছে। তবে, সরকার এবং অ্যাগ্রিটেক স্টার্টআপগুলি এই সমস্যাগুলি মোকাবিলায় কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষক সমবায়ের মাধ্যমে সরঞ্জাম ভাগাভাগি মডেল এবং পে-পার-ইউজ পরিষেবাগুলি ছোট কৃষকদের জন্য প্রযুক্তি সাশ্রয়ী করছে।

সরকারের ডিজিটাল ইন্ডিয়া ক্যাম্পেইন এবং ২০২৪-২৯ সালের জন্য ৬,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ পরিকল্পনা এআই এবং ড্রোন প্রযুক্তির প্রসারকে ত্বরান্বিত করছে। এছাড়া, অ্যাগ্রিটেক স্টার্টআপগুলি যেমন ফার্মোনট এবং ইন্টেলো ল্যাবস কৃষকদের জন্য সাশ্রয়ী এবং ব্যক্তিগতকৃত সমাধান প্রদান করছে, যা ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছে এবং পরিবেশের উপর প্রভাব কমাচ্ছে।

২০২৫ সালে ভারতীয় কৃষিতে এআই এবং ড্রোন প্রযুক্তির একীকরণ কৃষকদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। চ্যাটবটগুলি কৃষকদের তথ্য এবং পরামর্শ প্রদান করে, যখন ড্রোনগুলি নির্ভুল কৃষির মাধ্যমে সম্পদের ব্যবহার অপ্টিমাইজ করে। যদিও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সরকারি উদ্যোগ এবং অ্যাগ্রিটেক স্টার্টআপগুলির প্রচেষ্টার মাধ্যমে ভারতীয় কৃষি একটি টেকসই এবং উৎপাদনশীল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই প্রযুক্তিগুলি কৃষকদের ক্ষমতায়ন করছে এবং ভারতের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।