দেশে ডিজিটাল পেমেন্টের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে ইউনিফায়েড পেমেন্টস ইন্টারফেস (UPI)। তবে সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, জুন ২০২৫ সালে UPI লেনদেনের (UPI Transactions) শীর্ষ দশটি রাজ্যের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের নাম অনুপস্থিত। এই তথ্য প্রকাশের পর থেকে রাজ্যের ডিজিটাল অর্থনীতির অগ্রগতি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ইন্ডিয়ান ইনডেক্স (@Indian_Index) কর্তৃক প্রকাশিত একটি পোস্ট অনুসারে, মহারাষ্ট্র (৮.৮০%), কর্ণাটক (৫.৬১%), ও উত্তর প্রদেশ (৫.১৫%) এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের অবদান মোট লেনদেনের ১% এরও কম হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা “অন্যান্য” বিভাগে গণনা করা হয়েছে (৫৭.৯%)। এই তথ্য NCPI এবং SBI রিসার্চের উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
ডিজিটাল পেমেন্টে পিছিয়ে পড়ার কারণ কী?
পশ্চিমবঙ্গের UPI লেনদেনে এই নিম্ন অবদানের পেছনে বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ রয়েছে। প্রথমত, রাজ্যের গ্রামীণ এলাকাগুলোতে ডিজিটাল সাক্ষরতা এবং ইন্টারনেট সংযোগের অভাব এখনও একটি বড় বাধা। যদিও শহরগুলোতে, বিশেষ করে কলকাতায়, ডিজিটাল লেনদেন বৃদ্ধি পেয়েছে, তবুও গ্রামাঞ্চলে এই প্রযুক্তি অপ্রতুলভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। দ্বিতীয়ত, ঐতিহ্যবাহী নগদ লেনদেনের প্রতি রাজ্যের মানুষের নির্ভরশীলতা এখনও কমে যায়নি। বাজারে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে UPI গ্রহণযোগ্যতা কম থাকা এবং POS মেশিন বা QR কোডের অভাবও এর জন্য দায়ী।
একই সঙ্গে, রাজ্য সরকারের ডিজিটাল উদ্যোগগুলোর প্রভাবও এখনও পর্যাপ্তভাবে লোকের কাছে পৌঁছায়নি। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গে ই-চালান ব্যবস্থা চালু হলেও, এটি এখনও শুধুমাত্র ট্রাফিক ভাইওলেশনের মতো সীমিত ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। অন্যান্য রাজ্যগুলোতে, UPI-কে বিভিন্ন সরকারি পরিষেবায় একত্রিত করা হয়েছে, যা পশ্চিমবঙ্গে এখনও সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।
মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের সঙ্গে তুলনা
মহারাষ্ট্র এবং কর্ণাটকের মতো রাজ্যগুলো UPI লেনদেনে এগিয়ে থাকার কারণ হলো তাদের শিল্পায়ন এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন। মুম্বই এবং বেঙ্গালুরু যথাক্রমে ব্যাঙ্কিং ও টেক হাব হিসেবে পরিচিত, যেখানে ডিজিটাল অর্থনীতি ইতিমধ্যে গভীরভাবে রুঢ় হয়ে গেছে। এই শহরগুলোতে বড় ব্যাঙ্ক এবং প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো UPI-এর প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গে এ ধরনের একটি ইকোসিস্টেম এখনও সম্পূর্ণভাবে গড়ে ওঠেনি।
রাজ্যের সম্ভাবনা ও উন্নয়নের পথ
তবে, এটি মানতে হবে যে পশ্চিমবঙ্গের ডিজিটাল পেমেন্ট সেক্টরে সম্পূর্ণরূপে অগ্রগতি নেই তা নয়। শহরে যুবশক্তির মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহার এবং ইন্টারনেট সংযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা UPI গ্রহণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলেছে। সরকারের পক্ষ থেকে গ্রামীণ এলাকায় ডিজিটাল সাক্ষরতা প্রচার এবং UPI-সম্পর্কিত অ্যাপ-এর ব্যবহারে প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদি রাজ্য সরকার UPI-কে স্থানীয় বাজারে বাধ্যতামূলক করে তোলে এবং ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য সহজলভ্য ডিজিটাল পেমেন্ট সরঞ্জাম প্রদান করে, তবে পশ্চিমবঙ্গ শীঘ্রই এই তালিকায় স্থান করে নিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, তেলঙ্গানা (৪.৯৪%) এবং তামিলনাড়ু (৪.৩৭%) এমন রাজ্য যেগুলো কয়েক বছর আগে UPI-তে পিছিয়ে ছিল, কিন্তু সরকারি উদ্যোগে এখন উন্নতি লাভ করেছে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ
এক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো সাইবার সুরক্ষা। NPCI-এর মে ২০২৫ সালের নির্দেশিকা অনুসারে, UPI API-এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে, যা হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে। কিন্তু গ্রাহকদের মধ্যে এই নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি না হলে, তারা ডিজিটাল পেমেন্ট থেকে দূরে সরে যেতে পারে।
সুতরাং, পশ্চিমবঙ্গের জন্য এটি একটি সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ উভয়ই। যদি রাজ্য সরকার এবং ব্যাঙ্কিং সেক্টর একসঙ্গে কাজ করে, তবে ভবিষ্যতে UPI-তে পশ্চিমবঙ্গ নিশ্চিতভাবে এগিয়ে যেতে পারে। অন্যথায়, ডিজিটাল অর্থনীতির প্রবাহে রাজ্য পিছিয়ে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়ে গেছে।