সরকারি কর্মীদের কি প্রতি তিন মাসে স্বয়ংক্রিয় ডিএ বৃদ্ধি পাওয়া উচিত? বিশেষজ্ঞদের মতামত

সরকারি কর্মীদের মহার্ঘ ভাতা (DA hike) প্রতি তিন মাস অন্তর স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৃদ্ধি করা উচিত কি না, তা নিয়ে বর্তমানে ব্যাপক আলোচনা চলছে। ভারতের ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির…

6th vs 7th vs 8th Pay Commission Which Brought the Biggest Salary Hikes for Government Employees?

সরকারি কর্মীদের মহার্ঘ ভাতা (DA hike) প্রতি তিন মাস অন্তর স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৃদ্ধি করা উচিত কি না, তা নিয়ে বর্তমানে ব্যাপক আলোচনা চলছে। ভারতের ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে সরকারি কর্মীদের বেতনের সঙ্গে মূল্যস্ফীতি-সংযুক্ত ডিএ বৃদ্ধির দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার প্রতি ছয় মাসে একবার ডিএ বৃদ্ধির ঘোষণা করে, যা মূল্যস্ফীতির হারের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়। তবে, অনেক সরকারি কর্মী এবং তাদের সংগঠন দাবি করছে যে, মূল্যস্ফীতির দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতি তিন মাসে ডিএ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশোধন করা উচিত। এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন, যা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মহলে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

ডিএ বৃদ্ধির বর্তমান ব্যবস্থা
বর্তমানে, কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের জন্য ডিএ গণনা করা হয় অল ইন্ডিয়া কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স (এআইসিপিআই) এর উপর ভিত্তি করে। প্রতি ছয় মাসে এই সূচক পর্যালোচনা করে ডিএ বৃদ্ধির ঘোষণা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় সরকার ডিএ ৪ শতাংশ বাড়িয়ে ৫০ শতাংশে উন্নীত করেছে। এই বৃদ্ধি প্রায় ১ কোটি কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী ও পেনশনভোগীদের জন্য প্রযোজ্য। তবে, রাজ্য সরকারগুলি প্রায়শই কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের অনুসরণ করে তাদের কর্মীদের জন্য ডিএ বৃদ্ধি করে। পশ্চিমবঙ্গে, তৃণমূল কংগ্রেস সরকার সম্প্রতি রাজ্য সরকারি কর্মীদের জন্য ডিএ বৃদ্ধির ঘোষণা করেছে, যদিও এটি কেন্দ্রের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে।

   

তিন মাস অন্তর ডিএ বৃদ্ধির দাবি
সরকারি কর্মীদের সংগঠনগুলির দাবি, মূল্যস্ফীতির হার দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, এবং ছয় মাসের ব্যবধানে ডিএ সংশোধন জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। বিশেষ করে, জ্বালানি, খাদ্যদ্রব্য এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসের দামের দ্রুত বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারি কর্মীদেরও আর্থিক চাপে ফেলছে। একজন সরকারি কর্মী, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, বলেন, “প্রতি ছয় মাসে ডিএ বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়, কিন্তু এই সময়ের মধ্যে দ্রব্যমূল্য এতটাই বেড়ে যায় যে আমাদের আর্থিক সংকটে পড়তে হয়। প্রতি তিন মাসে স্বয়ংক্রিয় ডিএ বৃদ্ধি হলে আমরা মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারব।”

বিশেষজ্ঞদের মতামত
অর্থনীতিবিদ ড. সৌম্যজিৎ রায় বলেন, “প্রতি তিন মাসে ডিএ বৃদ্ধির প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা সম্ভব, তবে এর জন্য সরকারের আর্থিক কাঠামোর উপর অতিরিক্ত চাপ পড়বে। সরকারকে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজস্ব আয় এবং ব্যয়ের ভারসাম্য বিবেচনা করতে হবে।” তিনি আরও বলেন, স্বয়ংক্রিয় ডিএ বৃদ্ধির জন্য একটি সুনির্দিষ্ট সূত্র তৈরি করা যেতে পারে, যা মূল্যস্ফীতির সূচকের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত থাকবে। এটি সরকারি কর্মীদের জন্য আর্থিক স্থিতিশীলতা আনতে পারে।

অন্যদিকে, রাজনৈতিক বিশ্লেষক অমিতাভ চক্রবর্তী মনে করেন, “এই ধরনের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবেও প্রভাব ফেলতে পারে। সরকারি কর্মীরা একটি বড় ভোটব্যাঙ্ক। তিন মাস অন্তর ডিএ বৃদ্ধি করা হলে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়তে পারে, তবে এটি বিরোধী দলগুলির সমালোচনার কারণও হতে পারে।” তিনি আরও বলেন, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকারি কর্মীদের ডিএ নিয়ে সমালোচনার মুখে রয়েছে। তিন মাস অন্তর ডিএ বৃদ্ধির দাবি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।

অর্থনৈতিক প্রভাব
প্রতি তিন মাসে ডিএ বৃদ্ধির প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে সরকারের ব্যয় বাড়বে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি সরকারের রাজস্ব ঘাটতির উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তবে, এটি কর্মীদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সরকারি কর্মীদের হাতে অতিরিক্ত অর্থ থাকলে তারা বেশি ব্যয় করবে, যা খুচরা বাজার ও স্থানীয় অর্থনীতিকে উৎসাহিত করতে পারে।

Advertisements

বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়া
রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এই বিষয়ে বলেন, “সরকারি কর্মীদের ডিএ নিয়ে তৃণমূল সরকার ক্রমাগত বঞ্চনা করে চলেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের তুলনায় রাজ্যের ডিএ অনেক কম। তিন মাস অন্তর ডিএ বৃদ্ধির দাবি ন্যায্য, কিন্তু তৃণমূল সরকারের এই দাবি পূরণ করার ইচ্ছা বা সামর্থ্য নেই।” তিনি আরও দাবি করেন, এই ধরনের দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে তৃণমূল সরকারি কর্মীদের প্রতি প্রতারণা করছে।

সরকারি কর্মীদের প্রতিক্রিয়া
পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মীদের সংগঠন, যেমন সরকারি কর্মচারী পরিষদ, এই দাবির সপক্ষে সরব হয়েছে। তাদের নেতা সুজিত মণ্ডল বলেন, “মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের বেতন সংশোধন করা উচিত। প্রতি তিন মাসে স্বয়ংক্রিয় ডিএ বৃদ্ধি আমাদের জীবনযাত্রার মান বজায় রাখতে সাহায্য করবে।” তিনি আরও বলেন, রাজ্য সরকারের উচিত কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে ডিএ সমতা আনা।

চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা
প্রতি তিন মাসে ডিএ বৃদ্ধির জন্য একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করা প্রযুক্তিগতভাবে সম্ভব, তবে এর জন্য শক্তিশালী ডেটা সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণের ব্যবস্থা প্রয়োজন। মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং তা বেতনের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। এছাড়াও, এই ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি এবং আর্থিক সংস্থান অপরিহার্য।

প্রতি তিন মাসে স্বয়ংক্রিয় ডিএ বৃদ্ধির প্রস্তাব সরকারি কর্মীদের জন্য স্বস্তি আনতে পারে, তবে এটি বাস্তবায়নের পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সরকারের আর্থিক কাঠামো, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং মূল্যস্ফীতির হারের সঙ্গে সমন্বয় এই প্রস্তাবের সাফল্য নির্ধারণ করবে। পশ্চিমবঙ্গে, যেখানে ডিএ বৃদ্ধি নিয়ে সরকারি কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ দীর্ঘদিনের, এই দাবি নতুন করে রাজনৈতিক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আগামী দিনে সরকার এই বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা সরকারি কর্মীদের পাশাপাশি রাজ্যের রাজনৈতিক সমীকরণের উপরও প্রভাব ফেলবে।