অয়ন দে, কোচবিহার: রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর কনভয়ে ভাঙচুরের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই কোচবিহারের দিনহাটায় (Dinhata) নতুন করে রাজনৈতিক সংঘর্ষের অভিযোগ উঠেছে। দিনহাটা ২ নম্বর ব্লকের সালমারা এলাকায় চারজন বিজেপি কর্মীর (BJP worker) বাড়ি ভাঙচুরের পাশাপাশি এক বিজেপি কর্মীর অন্তঃসত্ত্বা মেয়ের পেটে লাথি মারার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় ওই মহিলা গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং তাঁকে কোচবিহারের একটি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস এই অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেছে যে এই ঘটনা বিজেপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফল। এই ঘটনা স্থানীয় রাজনৈতিক মহলে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সকালে দিনহাটা ২ নম্বর ব্লকের সালমারা গ্রামে চারজন বিজেপি কর্মী জুথিকা বর্মন, মৈনা বর্মন, পূরবী বর্মন এবং আরেকজনের বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে। এছাড়াও, এক বিজেপি কর্মীর অন্তঃসত্ত্বা মেয়ের পেটে লাথি মারার ঘটনায় এলাকায় তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ওই মহিলা ঘটনার পর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে তড়িঘড়ি কোচবিহারের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, তাঁর অবস্থা গুরুতর, এবং চিকিৎসা চলছে।
ওই মহিলার মা জয়ন্তী বর্মন এই ঘটনার বিষয়ে বলেন, “সকালে কিছু তৃণমূলের দুষ্কৃতী আমাদের বাড়িতে এসে ভাঙচুর শুরু করে। আমার অন্তঃসত্ত্বা মেয়ে যখন তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, তখন তারা তাকেও ছাড়েনি। তার পেটে লাথি মেরেছে। এরপরই আমার মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমরা অ্যাম্বুলেন্স ডাকলেও তারা অ্যাম্বুলেন্সকে ঢুকতে দেয়নি।” তিনি আরও অভিযোগ করেন, পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। এই ঘটনায় বিজেপি কর্মীরা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং দোষীদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুলেছেন।
এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, এর আগের দিন শুভেন্দু অধিকারীর কনভয়ে ভাঙচুরের ঘটনায় উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উদয়ন গুহ সহ ৪২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। বিজেপির দাবি, এই হামলা ছিল তৃণমূলের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এই ঘটনার পরই সালমারায় বিজেপি কর্মীদের বাড়িতে হামলা এবং অন্তঃসত্ত্বা মহিলার উপর নৃশংস আক্রমণের ঘটনা ঘটে। বিজেপির কোচবিহার জেলা সাংগঠনিক সভাপতি অভিজিৎ বর্মন বলেন, “এই হামলা তৃণমূলের প্রতিহিংসামূলক কাজ। শুভেন্দু অধিকারীর কনভয়ে হামলার ঘটনায় তৃণমূল কর্মীদের গ্রেফতারের প্রতিশোধ হিসেবে আমাদের কর্মীদের উপর এই নৃশংস আক্রমণ চালানো হয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির দাবি করছি।”
অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় নেতা বিশু ধর এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “এই ঘটনার সঙ্গে তৃণমূলের কোনও সম্পর্ক নেই। এটি বিজেপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফল। তারা নিজেদের মধ্যে ঝামেলা বাধিয়ে তৃণমূলের উপর দোষ চাপাচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, পুলিশ ঘটনার তদন্ত করছে এবং সত্য বেরিয়ে আসবে। তৃণমূলের দাবি, এই ধরনের অভিযোগ বিজেপির রাজনৈতিক প্রচারণার অংশ মাত্র।
এই ঘটনায় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। জয়ন্তী বর্মন অভিযোগ করেছেন, পুলিশ ঘটনাস্থলে থাকলেও দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। বিজেপি নেতৃত্বও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা করে বলেছে, “পুলিশ তৃণমূলের নির্দেশে কাজ করছে। আমাদের কর্মীদের উপর হামলা হলেও পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।” তারা এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কোচবিহারে এই ধরনের ঘটনা রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উত্তপ্ত হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দেয়। দিনহাটা, যেখানে বিজেপির শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে, সেখানে এই ধরনের সহিংসতা দুই দলের মধ্যে দ্বন্দ্বকে আরও তীব্র করছে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দিনহাটা আসনে বিজেপির নিশীথ প্রামাণিক মাত্র ৫৭ ভোটে তৃণমূলের উদয়ন গুহকে পরাজিত করেছিলেন। এই ঘটনার পর থেকে এলাকায় রাজনৈতিক উত্তেজনা অব্যাহত রয়েছে।
এই ঘটনা কোচবিহারে বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে চলমান রাজনৈতিক সংঘাতের একটি অংশ বলে মনে করা হচ্ছে। বিজেপি নেতৃত্ব দাবি করেছে, তৃণমূল তাদের কর্মীদের উপর পরিকল্পিতভাবে হামলা চালাচ্ছে, যাতে এলাকায় তাদের প্রভাব কমানো যায়। অন্যদিকে, তৃণমূলের অভিযোগ, বিজেপি এই ধরনের ঘটনাকে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্য ব্যবহার করছে।
এই ঘটনার পর সালমারা এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিজেপি কর্মীরা প্রতিবাদ মিছিল এবং পথ অবরোধের পরিকল্পনা করছে। পুলিশ জানিয়েছে, তারা ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে, এই ঘটনা রাজনৈতিকভাবে কী প্রভাব ফেলবে, তা আগামী দিনে স্পষ্ট হবে।
এই ধরনের সহিংসতা এবং দলবদলের ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি করছে। পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুরে বিজেপি থেকে তৃণমূলে যোগদানের ঘটনার পর দিনহাটার এই ঘটনা রাজ্যের রাজনৈতিক সমীকরণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে এই ধরনের ঘটনা দুই দলের মধ্যে দ্বন্দ্বকে আরও তীব্র করতে পারে।