ভারতের উপকূলবর্তী অঞ্চলে কার্গো পরিবহনকে উৎসাহ দিতে এবং দেশীয় নৌপরিবহন ব্যবস্থাকে আরও সুসংহত করতে ‘কোস্টাল শিপিং বিল, ২০২৫’ (Coastal Shipping Bill 2025) বৃহস্পতিবার রাজ্যসভায় পাস হয়েছে। এর আগে, ৩ এপ্রিল লোকসভায় বিলটি পাস হয়েছিল। বিলটির লক্ষ্য—ভারতের বিস্তৃত এবং কৌশলগত উপকূলরেখার পূর্ণ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং উপকূলীয় বাণিজ্যের জন্য একটি বিশেষ আইনি কাঠামো তৈরি করা।
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা ভারতের সমুদ্রপথ-নির্ভর পরিবহন খাতকে সহজ, কার্যকর এবং ‘ease of doing business’-এর দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করবে।
মূল উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি:
বিলটি উত্থাপন করে কেন্দ্রীয় বন্দর, নৌপরিবহন ও জলপথ মন্ত্রী সারবানন্দ সোনোয়াল বলেন, “এই আইন ভারতের উপকূলরেখার পূর্ণ সম্ভাবনা উন্মোচনে সহায়ক হবে। উপকূলীয় কার্গোর অংশ ২০৩০ সালের মধ্যে ২৩ কোটি টনে উন্নীত করতে হলে আমাদের এমন একটি কাঠামো দরকার যা নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে উন্নয়নের সুযোগ বাড়ায়।”
তিনি আরও বলেন, বর্তমান উপকূলীয় শিপিং-এর নিয়ন্ত্রণ ও লাইসেন্সিং ১৯৫৮ সালের Merchant Shipping Act-এর আওতায় চলত। নতুন এই বিল এক আধুনিক, বাস্তবমুখী এবং আন্তর্জাতিক মানের কাঠামো দেবে, যা বাণিজ্যিক চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বিরোধীদের প্রতিবাদ এবং সংসদের বিতর্ক:
বিলটি যখন রাজ্যসভায় পেশ করা হয়, তখন বিহারে ভোটার তালিকার বিশেষ সংশোধন (Special Intensive Revision – SIR) নিয়ে বিরোধীরা সংসদে স্লোগান দিতে থাকে। এই প্রতিবাদের মাঝেও বিলটি ভয়েস ভোটের মাধ্যমে পাস হয়।
বিলটি নিয়ে সংক্ষিপ্ত বিতর্কে অংশ নেন বেশ কয়েকজন সাংসদ—যাদের মধ্যে রয়েছেন ওয়াইএসআরসিপি-র গোল্লা বাবুরাও, এআইএডিএমকে-র থাম্বিদুরাই, বিজেপি-র কল্যাণী সাইনি ও দর্শনা সিং, শিবসেনা-র মিলিন্দ দেওরা, টিডিপি-র মাস্তান রাও, এজিপি-র বিরেন্দ্র বৈশ্য প্রমুখ।
এআইএডিএমকে সাংসদ থাম্বিদুরাই আলোচনার সময় তামিল জেলেদের সমস্যা ও কচ্ছতিভু দ্বীপের প্রসঙ্গ তোলেন, যা নিয়ে ডিএমকে সাংসদ তিরুচি শিবা পয়েন্ট অফ অর্ডার তোলেন এবং বলেন যে, উক্ত বক্তব্য বিলের সাথে সম্পর্কিত নয় ও তা রেকর্ড থেকে বাদ দেওয়া উচিত। এরপর সংসদের চেয়ার থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়—বিল সংক্রান্ত নয়, এমন কোনো বক্তব্য রেকর্ডে নেয়া হবে না।
বিলের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো:
আইনি কাঠামো: এই আইন ভারতের উপকূলীয় নৌপরিবহন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নয়নের জন্য একটি নির্দিষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ কাঠামো দেবে।
ঘরোয়া অংশগ্রহণের উৎসাহ: উপকূলীয় বাণিজ্যে ভারতীয় নাগরিকদের মালিকানাধীন ও পরিচালিত জাহাজকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এর মাধ্যমে দেশীয় শিল্প, বিশেষ করে ভারতীয় জাহাজ নির্মাণ ও নাবিকদের কর্মসংস্থান বাড়বে।
বিদেশি জাহাজের সীমিত অংশগ্রহণ: বিদেশি জাহাজ শুধুমাত্র ডিরেক্টর জেনারেল অফ শিপিং-এর লাইসেন্সের মাধ্যমে উপকূলীয় বাণিজ্যে অংশ নিতে পারবে এবং তাও কিছু নির্দিষ্ট শর্ত মেনে।
নতুন রোডম্যাপ ও কৌশলগত পরিকল্পনা: বিল অনুযায়ী, একটি ‘ন্যাশনাল কোস্টাল অ্যান্ড ইনল্যান্ড শিপিং স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান’ তৈরি করা হবে, যা প্রতি দুই বছর অন্তর হালনাগাদ হবে। এর লক্ষ্য—রুট পরিকল্পনা উন্নত করা, ভবিষ্যৎ ট্র্যাফিক অনুমান করা এবং উপকূলীয় শিপিংকে অভ্যন্তরীণ জলপথের সঙ্গে সংযুক্ত করা।
উপকূলীয় জলসীমার সংজ্ঞা: এই আইন অনুযায়ী, উপকূলীয় জলসীমা বলতে ভারতের টেরিটোরিয়াল ও অতিরিক্ত সামুদ্রিক এলাকা বোঝানো হয়েছে।
টেরিটোরিয়াল জলসীমা উপকূল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল (প্রায় ২২ কিমি) পর্যন্ত বিস্তৃত।
adjoining maritime zones বা সমুদ্রসীমা উপকূল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল (প্রায় ৩৭০ কিমি) পর্যন্ত বিস্তৃত।
কেন এই আইন গুরুত্বপূর্ণ?
ভারতের উপকূলরেখা প্রায় ৭,৫০০ কিমি দীর্ঘ, যা দেশের অর্থনৈতিক, কৌশলগত এবং বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এতদিন উপকূলীয় শিপিং-এ বাধ্যবাধকতা, লাইসেন্স জটিলতা ও যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে সম্ভাবনার অনেকটাই অব্যবহৃত ছিল।
এই নতুন আইন:
মালবাহী পরিবহনকে সস্তা ও দক্ষ করবে, ট্র্যাফিক বোঝা কমাতে সাহায্য করবে, পরিবেশবান্ধব জাহাজ চলাচলে উৎসাহ দেবে ও দেশের সাপ্লাই চেইন সিকিউরিটি নিশ্চিত করবে।
‘কোস্টাল শিপিং বিল, ২০২৫’ শুধু একটি আইন নয়—এটি ভারতের উপকূলরেখা-নির্ভর উন্নয়নের দিকে একটি বড় পদক্ষেপ। যদি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে এবং পরিবহন খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে।