বছরের পর বছর ধরে বর্ষা মানেই হাওড়ার উদয়নারায়ণপুর ও আমতা অঞ্চলের মানুষের কাছে ছিল এক আতঙ্কের নাম—বন্যা। বিশেষ করে ডিভিসি (Damodar River) (দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন)-র জলাধার থেকে বর্ষার সময় যে জল ছাড়া হতো, তার সরাসরি প্রভাবেই এই দুই অঞ্চল প্লাবিত হতো। চাষের জমি থেকে শুরু করে বসতঘর, এমনকি স্কুল, বাজার—সবকিছুই চলে যেত জলের তলায়।
কিন্তু ২০২৫-এর বর্ষায় দেখা গেল এক বিরল চিত্র। হুগলি জেলার খানাকুল, আরামবাগ অঞ্চলে যখন জল ঢুকে পড়ছে, তখন পাশের উদয়নারায়ণপুর এবং আমতা এলাকায় বন্যার কোনও প্রভাবই নেই। আর তাতেই বিস্মিত স্থানীয় মানুষ। প্রশ্ন উঠছে, এমন পরিবর্তনের কারণ কী?
সেচ দপ্তরের এক আধিকারিক জানাচ্ছেন, মূল পার্থক্যটা এসেছে দামোদর নদের (Damodar River) সম্প্রতি করা সংস্কারের মাধ্যমে। আগে ডিভিসি’র(Damodar River) জলাধার থেকে ৭০ হাজার থেকে এক লক্ষ কিউসেক জল ছাড়লেই উদয়নারায়ণপুরে বন্যা দেখা দিত। এবার সেই জলছাড়া পৌঁছেছে দেড় লক্ষ কিউসেক পর্যন্ত, তবুও এলাকা এখনও নিরাপদ। কারণ, দামোদর এখন সেই পরিমাণ জল ধারণ করতে পারছে। নদীর (Damodar River) পলি অপসারণ, গভীরতা বৃদ্ধি এবং নদীবাঁধের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে জল প্রবাহ স্বাভাবিক থাকছে।
তবে শুধু নদী নয়, দামোদরের সঙ্গে সংযোগকারী বহু খালও সংস্কার করা হয়েছে। এই খালগুলির প্রবাহপথ পরিষ্কার করায় অতিরিক্ত জল সহজেই বেরিয়ে যেতে পারছে, ফলে বন্যার (Damodar River) সৃষ্টি হচ্ছে না।
এই আমূল পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে রাজ্য সরকারের পরিকল্পিত পদক্ষেপ। কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এক মেগা প্রকল্প হাতে নেয় উদয়নারায়ণপুর ও আমতার দীর্ঘস্থায়ী বন্যা সমস্যার সমাধানে। বিশ্বব্যাঙ্কের আর্থিক সহায়তায় প্রায় ২৯০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয় এই প্রকল্পে। হাওড়া, হুগলি এবং পূর্ব বর্ধমান জেলা জুড়ে দামোদর নদীর পলি সরানো, বাঁধ নির্মাণ এবং নদী খননের কাজ হয় একযোগে।
সেচ দপ্তরের ইঞ্জিনিয়ারদের দাবি, প্রকল্পটির ফলাফল এ বছর থেকেই স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। দীর্ঘ সময় ধরে চলা নির্মাণ ও সংস্কারকাজ শেষ হওয়ায় নদী ও খালপথ এখন অনেক বেশি কার্যকর হয়েছে। অতিরিক্ত জল প্রবাহের চাপ সহজে সামাল দেওয়া যাচ্ছে।
উদয়নারায়ণপুরের বিধায়ক সমীর পাঁজা বলেন, ‘‘এই অঞ্চলে বর্ষা এলেই বন্যা হবে, এটা একটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। বহু বছর ধরে মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পরে তিনি এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের নির্দেশ দেন। পরিকল্পনা নেওয়া হয়, এবং সেই পরিকল্পনার বাস্তব রূপ আমরা এবার দেখতে পাচ্ছি।’’ তিনি আরও জানান, উদয়নারায়ণপুরবাসী আজ মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ, কারণ তাঁর উদ্যোগেই এই সাফল্য সম্ভব হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারাও বলছেন, এত বছর পর এমন বর্ষা পেলেন, যেখানে নদীর জলস্ফীতি সত্ত্বেও গ্রামের রাস্তাঘাট, বাড়িঘর বা মাঠঘাটে জল ঢোকেনি। অনেকেই জানিয়েছেন, আগে বর্ষা এলেই পরিবার নিয়ে অন্যত্র সরে যেতে হতো। এবার সেসব ছেড়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন তারা।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে—এই সাফল্য কি স্থায়ী হবে? বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণ যদি নিয়মিতভাবে চালু রাখা যায়, তবে এই পরিস্থিতি ভবিষ্যতেও বজায় থাকবে। তবে যদি অবহেলা হয়, তবে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে বেশি সময় লাগবে না।
তবু আপাতত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন উদয়নারায়ণপুর ও আমতার মানুষ। তাঁদের জীবনে দীর্ঘদিন পর এসেছে বর্ষা নিয়ে আশঙ্কার পরিবর্তে স্বস্তি। সরকার, প্রশাসন ও মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বদলে যাচ্ছে এলাকার চিত্র।