রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার (RBI) গভর্নর সঞ্জয় মালহোত্রা সর্বশেষ নীতিগত হারে ঘোষণা দেওয়ার সময় জানিয়েছেন যে, দেশের কর্পোরেট সংস্থাগুলি এখন ক্রমবর্ধমান হারে প্রচলিত ব্যাংক ঋণের বদলে বন্ড মার্কেট ও অন্যান্য বাজারভিত্তিক আর্থিক উপায় বেছে নিচ্ছে। তার মতে, নীতিগত হারের পরিবর্তনের প্রভাব ব্যাংকিং ব্যবস্থার তুলনায় মানি মার্কেটে দ্রুত পৌঁছনোর ফলেই এই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
গভর্নর বলেন, “নীতিগত হারের প্রভাব মানি মার্কেটে দ্রুত পৌঁছচ্ছে। ফলে বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলি এখন বাণিজ্যিক কাগজ (Commercial Paper বা CP) ও কর্পোরেট বন্ডের মতো বাজারভিত্তিক আর্থিক উপায়ে তহবিল সংগ্রহে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে।”
বাজারমুখী ঋণে কর্পোরেটদের ঝোঁক বাড়ছে:
এই পরিবর্তন মূলত কর্পোরেটদের বৃহত্তর আর্থিক নমনীয়তা এবং দ্রুত অর্থ সংস্থানের প্রয়োজনের প্রতিফলন বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ঋণের খরচ কম হওয়া, স্বচ্ছ প্রক্রিয়া এবং দ্রুত ফান্ড ট্রান্সমিশনের সুবিধা থাকায় CP ও কর্পোরেট বন্ডের মত ঋণ উপকরণগুলি দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
ব্যাংক ঋণ এখনো কর্পোরেট অর্থসংস্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলেও এর প্রবৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে কমছে। RBI-এর সাম্প্রতিক তথ্যানুসারে, ২০২৪–২৫ অর্থবর্ষে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ১২.১ শতাংশ হয়েছে, যা আগের বছরের ১৬.৩ শতাংশ থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে কম। যদিও, এটি এখনো গত এক দশকের গড় প্রবৃদ্ধি হার ১০.৩ শতাংশের চেয়ে বেশি।
বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহে বড় ঋণ বৃদ্ধি:
তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩–২৪ সালে যেখানে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে মোট আর্থিক সংস্থান ছিল ৩৩.৯ লাখ কোটি টাকা, ২০২৪–২৫ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩৪.৮ লাখ কোটি টাকা। এর পিছনে মূল চালিকা শক্তি ছিল ব্যাংকের বাইরের উৎস থেকে আসা প্রবাহ, অর্থাৎ বাজার-ভিত্তিক অর্থসংস্থান।
এই প্রেক্ষাপটে, CP এবং কর্পোরেট বন্ডের ব্যবহার নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। RBI জানিয়েছে, ২০২৫–২৬ অর্থবর্ষের (জুন পর্যন্ত) মধ্যে CP ইস্যু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ০.৭৮ লাখ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ০.৩০ লাখ কোটি টাকা। একইভাবে, কর্পোরেট বন্ড ইস্যুও বেড়ে হয়েছে ০.৯৫ লাখ কোটি টাকা, যেখানে ২০২৪–২৫ সালের একই সময়ে ছিল মাত্র ০.০৯ লাখ কোটি টাকা।
কী এই কমার্শিয়াল পেপার (CP)?
কমার্শিয়াল পেপার (CP) একটি স্বল্পমেয়াদি, সুরক্ষাহীন মানি মার্কেট উপকরণ, যা মূলত কর্পোরেট সংস্থাগুলি তাদের কার্যকরী মূলধনের চাহিদা পূরণের জন্য ব্যবহার করে থাকে। এর মেয়াদ সাধারণত ৭ দিন থেকে ১ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং এটি তুলনামূলকভাবে কম হারে তহবিল সংগ্রহের সুযোগ দেয়।
অভ্যন্তরীণ রিজার্ভ ব্যবহারে কর্পোরেটদের আগ্রহ:
শুধু বাজার থেকেই নয়, অনেক বড় সংস্থা নিজেদের অভ্যন্তরীণ রিজার্ভ থেকেও অর্থ তুলে নিচ্ছে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ত্রৈমাসিকে মুনাফা বৃদ্ধির ফলে, এই সংস্থাগুলির হাতে বাড়তি অর্থ এসেছে, যা তারা নতুন বিনিয়োগ এবং দৈনন্দিন খরচে ব্যবহার করছে।
ব্যাংকের বাইরে অর্থায়নের অভিমুখে পরিবর্তন:
বিশেষজ্ঞদের মতে, কর্পোরেট অর্থ সংস্থানে এই প্রবণতা আগামী দিনে আরও জোরদার হবে। CP ও কর্পোরেট বন্ডের মাধ্যমে অর্থ সংস্থার প্রক্রিয়া তুলনামূলকভাবে দ্রুত এবং ব্যয়বহুল নয়। পাশাপাশি, বাজারভিত্তিক পদ্ধতিতে সুদের হার নিয়ে অধিক নমনীয়তা থাকে। এর ফলে, সংস্থাগুলি তহবিল ব্যবস্থাপনায় আরও কৌশলী হতে পারছে।
একদিকে যেমন ব্যাংক ঋণ গ্রহণের প্রবণতা কিছুটা কমেছে, অন্যদিকে কর্পোরেটরা অর্থ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন বিকল্প পন্থা খুঁজে পাচ্ছে। RBI-এর নীতিগত প্রভাব যদি মানি মার্কেটে দ্রুত প্রতিফলিত হয়, তবে কর্পোরেটরা আগামী দিনেও বন্ড মার্কেট বা CP-এর পথেই হাঁটবে বলে আশা করা যায়।
ব্যাংকের বাইরে গিয়ে বাজারনির্ভর অর্থায়নের এই প্রবণতা দেশের কর্পোরেট সেক্টরের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। এর ফলে, কর্পোরেট সংস্থাগুলির হাতে তহবিল সংগ্রহের নতুন দরজা খুলছে এবং আর্থিক খাতে আরও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।
এটা স্পষ্ট যে, আগামী দিনে ব্যাংক ছাড়াও আরও বেশি বাজারভিত্তিক আর্থিক উপকরণই কর্পোরেটদের প্রথম পছন্দ হয়ে উঠবে। এই প্রবণতা শুধু আর্থিক স্থিতিশীলতাই আনবে না, বরং দেশের সামগ্রিক আর্থিক ব্যবস্থাকে আরও গতিশীল ও উদ্ভাবনী করে তুলবে।