ভারতের কৃষক সংগঠনগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত নতুন কৃষি খসড়া বিল (Agriculture Draft Bill) ২০২৫-এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এই বিলে ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (এমএসপি) এর আইনি গ্যারান্টি এবং কৃষকদের জন্য পূর্ণ ঋণ মাফের মতো গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলির অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা (এসকেএম) এবং কিষাণ মজদুর মোর্চার মতো সংগঠনগুলি। ২০২০-২০২১ সালের কৃষক আন্দোলনের পর এই নতুন বিল নিয়ে কৃষকদের মধ্যে আবারও অসন্তোষ ছড়িয়েছে, এবং তারা ‘দিল্লি চলো’ আন্দোলনের মতো বড় ধরনের প্রতিবাদের হুমকি দিয়েছে। পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তর প্রদেশের কৃষকরা ইতিমধ্যেই শম্ভু সীমান্তে সমবেত হতে শুরু করেছে, যেখানে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলমান প্রতিবাদ চলছে।
নতুন কৃষি খসড়া বিল ২০২৫: প্রধান বিষয়বস্তু
নতুন কৃষি খসড়া বিল ২০২৫-এ কৃষি বিপণন, চুক্তিভিত্তিক চাষ এবং প্রয়োজনীয় পণ্যের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। সরকার দাবি করেছে যে এই বিল কৃষকদের বেসরকারি ক্রেতাদের কাছে তাদের পণ্য বিক্রির স্বাধীনতা দেবে এবং বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে কৃষকদের আয় বৃদ্ধি করবে। তবে, কৃষক সংগঠনগুলি এই বিলকে ২০২০ সালের তিনটি কৃষি আইনের একটি পরিবর্তিত রূপ হিসেবে দেখছে, যেগুলি তীব্র প্রতিবাদের পর ২০২১ সালে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। এই বিলে এমএসপি-র আইনি গ্যারান্টি এবং ঋণ মাফের মতো মূল দাবিগুলি উপেক্ষা করা হয়েছে, যা কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভের প্রধান কারণ।
২০২০ সালের কৃষি আইনগুলির বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় কৃষকরা দাবি করেছিল যে এই আইনগুলি তাদের বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলির কাছে অরক্ষিত করে দেবে। নতুন খসড়া বিলেও অনুরূপ আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়নের (বিকেউ) নেতা রাকেশ টিকৈত বলেছেন, “এই বিল কৃষকদের জন্য নয়, কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তৈরি। আমরা এমএসপি-র আইনি গ্যারান্টি এবং ঋণ মাফ ছাড়া এই বিল মেনে নেব না।” এছাড়াও, কৃষকরা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) থেকে ভারতের প্রত্যাহার এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে, কারণ এই চুক্তিগুলি কৃষকদের ঐতিহ্যবাহী চাষ পদ্ধতির উপর বাধা সৃষ্টি করে বলে তারা মনে করে।
কৃষকদের প্রধান দাবি
কৃষক সংগঠনগুলির ১২-দফা দাবির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সকল ফসলের জন্য এমএসপি-র আইনি গ্যারান্টি। ড. এম এস স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, এমএসপি উৎপাদন খরচের উপর ৫০% লাভ সহ নির্ধারণ করা উচিত। বর্তমানে এমএসপি কেবলমাত্র ধান এবং গমের জন্য কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হয়, যা মাত্র ৭% কৃষকদের উপকার করে। অন্যান্য দাবিগুলির মধ্যে রয়েছে:
- সমস্ত কৃষক এবং কৃষি শ্রমিকদের জন্য পূর্ণ ঋণ মাফ।
- ২০২০-২০২১ আন্দোলনের সময় মৃত কৃষকদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ এবং একজন পরিবারের সদস্যের জন্য চাকরি।
- বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল ২০২০ প্রত্যাহার, যা বিদ্যুৎ বেসরকারিকরণের পথ প্রশস্ত করতে পারে।
- মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি আইন (এমজিএনআরইজিএ) এর অধীনে বছরে ২০০ দিনের কর্মসংস্থান এবং প্রতিদিন ৭০০ টাকা মজুরি।
- লখিমপুর খেরি গণহত্যার অপরাধীদের শাস্তি এবং কৃষকদের জন্য পেনশন।
সরকারের প্রতিক্রিয়া ও কৃষকদের অবস্থান
কেন্দ্রীয় সরকার এই বিলকে কৃষি খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর একটি উপায় হিসেবে উপস্থাপন করেছে। তবে, কৃষকরা এই দাবিকে “বিলম্ব করার কৌশল” হিসেবে দেখছে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার পাঁচ বছরের জন্য ডাল এবং ভুট্টার জন্য এমএসপি-তে ক্রয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু কৃষক নেতারা এটি প্রত্যাখ্যান করেছেন, কারণ এটি সকল ফসলের জন্য আইনি গ্যারান্টি প্রদান করে না। এসকেএম (অ-রাজনৈতিক) এক বিবৃতিতে বলেছে, “সরকার আমাদের দাবিগুলি উপেক্ষা করছে। আমরা দিল্লির সীমান্তে প্রতিবাদ চালিয়ে যাব এবং প্রয়োজনে আরও বড় আন্দোলন শুরু করব।”
২০২৪ সালের প্রতিবাদের সময় পাঞ্জাব-হরিয়ানা সীমান্তে শম্ভু এবং খানৌরি-জিন্দে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে একজন তরুণ কৃষকের মৃত্যু হয়েছিল, যা কৃষকদের মধ্যে আরও ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। কৃষক নেতা জগজিৎ সিং দল্লেওয়ালের একটি ভিডিও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, যেখানে তিনি বলেছেন যে এই প্রতিবাদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা কমানোর একটি সুযোগ। এই মন্তব্যের জন্য হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী খট্টর সমালোচনা করলেও, কংগ্রেস নেতা পবন খেরা কৃষকদের রাজনৈতিক মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন।
কৃষকদের উদ্বেগ ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট
কৃষকরা বলছেন, গত কয়েক বছরে চাষের খরচ বেড়েছে, কিন্তু আয় স্থবির হয়ে পড়েছে। ২০১৬ সালে সরকার কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু তা পূরণ হয়নি। ডিজেল, বিদ্যুৎ এবং সারের দাম বৃদ্ধি কৃষকদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছে। শান্তা কুমার কমিটির ২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, মাত্র ৬% কৃষক এমএসপি-র সুবিধা পান, কারণ রাজ্য সরকারগুলির পর্যাপ্ত স্টোরেজ ক্ষমতার অভাব রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, নতুন বিল কৃষকদের বাজারের অস্থিরতার মুখে ফেলতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।
রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
নতুন বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কেবল কৃষি সংস্কারের বিষয় নয়, এটি রাজনৈতিক প্রভাবও ফেলছে। পাঞ্জাব এবং উত্তর প্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে, যেখানে কৃষকরা একটি শক্তিশালী ভোটব্যাঙ্ক, এই প্রতিবাদ স্থানীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে। ২০২০-২০২১ সালের আন্দোলন কৃষকদের ঐক্য এবং গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের শক্তি প্রদর্শন করেছিল, যা বিশ্বব্যাপী সমর্থন পেয়েছিল। এই প্রতিবাদে মহিলা কৃষকদের নেতৃত্বও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যা কৃষি আন্দোলনে লিঙ্গ-সমতার একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
নতুন কৃষি খসড়া বিল ২০২৫ নিয়ে কৃষক সংগঠনগুলির প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট করে দিয়েছে যে এমএসপি-র আইনি গ্যারান্টি এবং ঋণ মাফ ছাড়া তারা কোনও সংস্কার মেনে নেবে না। সরকার এবং কৃষকদের মধ্যে আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায়, শম্ভু সীমান্তে প্রতিবাদ আরও তীব্র হতে পারে। এই পরিস্থিতি কৃষি খাতে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা এবং কৃষকদের ন্যায্য আয় নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জের উপর আলোকপাত করেছে। আগামী দিনগুলিতে এই আন্দোলন কোন দিকে যায়, তা ভারতের কৃষি নীতি এবং রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।