জৈব চাষে নতুন দিগন্ত! বঙ্গের কৃষকরা গোমূত্র-ভিত্তিক জৈব কীটনাশক ব্যবহার করে খরচ কমাচ্ছেন

পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা ক্রমশ জৈব চাষের দিকে ঝুঁকছেন এবং এই প্রক্রিয়ায় গোমূত্র-ভিত্তিক জৈব (Cow Urine natural farming) কীটনাশকের ব্যবহার তাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। রাসায়নিক কীটনাশকের…

Bengal Farmers Embrace Cow Urine-Based Bio-Pesticides to Slash Costs and Boost Sustainable Farming

পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা ক্রমশ জৈব চাষের দিকে ঝুঁকছেন এবং এই প্রক্রিয়ায় গোমূত্র-ভিত্তিক জৈব (Cow Urine natural farming) কীটনাশকের ব্যবহার তাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। রাসায়নিক কীটনাশকের উচ্চ খরচ এবং পরিবেশের উপর এর ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে কৃষকরা এখন প্রাকৃতিক বিকল্পের দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন। গোমূত্র, যা সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী, কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী এবং পরিবেশবান্ধব হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে। এই পদ্ধতি শুধুমাত্র উৎপাদন খরচ কমাচ্ছে না, বরং মাটির উর্বরতা এবং ফসলের গুণগত মান বজায় রাখতে সহায়তা করছে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের এই উদ্যোগ জৈব চাষের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।

গোমূত্র-ভিত্তিক জৈব কীটনাশক: একটি টেকসই বিকল্প
গোমূত্র-ভিত্তিক জৈব কীটনাশক কৃষকদের জন্য একটি সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গোমূত্রে ৯৫% জল, ২.৫% ইউরিয়া এবং বাকি ২.৫% খনিজ লবণ, হরমোন এবং এনজাইম থাকে, যা ফসলের কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে এবং মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে কার্যকর। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর, হুগলি, এবং বর্ধমানের মতো জেলাগুলিতে কৃষকরা গোমূত্রের সঙ্গে নিম পাতা, রসুন, পেঁয়াজ, এবং লঙ্কার মিশ্রণ ব্যবহার করে জৈব কীটনাশক তৈরি করছেন। এই মিশ্রণ, যেমন নিমাস্ত্র, ব্রহ্মাস্ত্র, এবং অগ্নিস্ত্র, কীটপতঙ্গ, ছত্রাক, এবং অন্যান্য রোগজনকের বিরুদ্ধে কার্যকর। উদাহরণস্বরূপ, ১০ লিটার গোমূত্রের সঙ্গে ৫০০ গ্রাম রসুন, ১০০ গ্রাম পেঁয়াজ, ৫০০ গ্রাম লঙ্কা, এবং ৫০০ গ্রাম তামাক পাতা মিশিয়ে তৈরি মিশ্রণ একটি শক্তিশালী জৈব কীটনাশক হিসেবে কাজ করে। এই মিশ্রণটি একটি বন্ধ পাত্রে কয়েক দিন গাঁজিয়ে ঘনীভূত করে ফসলে স্প্রে করা হয়।

   

বিশেষজ্ঞদের মতে, গোমূত্রে উপস্থিত জৈব যৌগ কীটপতঙ্গকে তাড়ায় এবং ফসলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ২০১৬ সালে বিজনোর জেলায় পরিচালিত একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, গোমূত্র-ভিত্তিক জৈব কীটনাশক রাসায়নিক কীটনাশকের তুলনায় সমানভাবে কার্যকর এবং এটি মাটির উর্বরতা হ্রাস করে না বা ক্ষতিকর অবশিষ্টাংশ রাখে না। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা এই পদ্ধতি গ্রহণ করে উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, রাসায়নিক কীটনাশকের জন্য প্রতি বিঘা জমিতে ১০০-১৫০ টাকা খরচ হতে পারে, যেখানে গোমূত্র-ভিত্তিক কীটনাশকের খরচ মাত্র ৩৫-৫০ টাকা। এটি কৃষকদের জন্য একটি লাভজনক বিকল্প।

পশ্চিমবঙ্গে জৈব চাষের উত্থান
পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা জৈব চাষের দিকে ঝুঁকছেন কারণ রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার মাটির উর্বরতা হ্রাস করছে এবং ফসলের গুণগত মান নষ্ট করছে। উত্তর দিনাজপুর জেলার কালিয়াগঞ্জে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গোমূত্র এবং গোবর-ভিত্তিক জৈব সার ব্যবহার করে ধান, গম, এবং সবজির ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কীটপতঙ্গের আক্রমণ কমেছে। এই পদ্ধতি ফসলের জৈব রাসায়নিক উপাদান বাড়ায়, যা ফসলের পুষ্টিগুণ উন্নত করে।

গোমূত্রের ব্যবহার শুধু কীটনাশক হিসেবেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে। গোমূত্রে থাকা উপকারী অণুজীব মাটির গঠন উন্নত করে এবং জল ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়ায়। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কৃষকরা জানিয়েছেন, গোমূত্র এবং নিম পাতার মিশ্রণ ব্যবহার করে তারা ধান এবং আলুর ফসলে পাউডারি মিলডিউ এবং লিফ মাইনারের মতো রোগ ও কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এছাড়াও, এই পদ্ধতি রাসায়নিক কীটনাশকের তুলনায় পরিবেশের জন্য নিরাপদ এবং কৃষক, ভোক্তা, এবং বাজারের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না।

কৃষকদের জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা
গোমূত্র-ভিত্তিক জৈব কীটনাশকের ব্যবহার পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। রাসায়নিক কীটনাশকের দাম প্রতি লিটার ৫০০-১০০০ টাকা হতে পারে, যেখানে গোমূত্র স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য এবং প্রায় বিনামূল্যে পাওয়া যায়। কৃষকরা তাদের নিজস্ব গবাদি পশু থেকে গোমূত্র সংগ্রহ করেন এবং সামান্য পরিমাণ অন্যান্য উপাদান, যেমন নিম পাতা বা রসুন, বাজার থেকে কম খরচে কিনে নেন। এই পদ্ধতি উৎপাদন খরচ ৩০-৪০% কমিয়ে দেয়, যা ছোট এবং মাঝারি কৃষকদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী।

Advertisements

উদাহরণস্বরূপ, বর্ধমানের কৃষক রামেশ্বর মণ্ডল জানিয়েছেন, “আমি গত দুই বছর ধরে গোমূত্র এবং নিম পাতার মিশ্রণ ব্যবহার করছি। এতে আমার ধানের ফসলে কীটপতঙ্গের আক্রমণ কমেছে এবং খরচও অনেক কম হয়েছে। আগে প্রতি বিঘায় ২০০ টাকার রাসায়নিক কীটনাশক লাগত, এখন মাত্র ৪০-৫০ টাকায় কাজ হয়ে যায়।” এই ধরনের উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে আছে, যেখানে কৃষকরা জৈব চাষের মাধ্যমে লাভ বাড়াচ্ছেন।

সরকারি উদ্যোগ এবং চ্যালেঞ্জ
পশ্চিমবঙ্গ সরকার জৈব চাষকে উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। কৃষি বিভাগ কৃষকদের জৈব কীটনাশক তৈরির প্রশিক্ষণ এবং সরঞ্জাম সরবরাহ করছে। তবে, এই পদ্ধতির ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, অনেক কৃষকের মধ্যে জৈব কীটনাশক তৈরির প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব রয়েছে। দ্বিতীয়ত, জৈব পণ্যের বাজার মূল্য এখনও তুলনামূলকভাবে কম, যা কৃষকদের জন্য প্রণোদনা হ্রাস করে। তৃতীয়ত, গোমূত্র-ভিত্তিক কীটনাশক তৈরির জন্য সঠিক সংরক্ষণ এবং প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতনতার প্রয়োজন।

সরকার এবং কৃষি গবেষণা সংস্থাগুলির উচিত কৃষকদের আরও প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। উদাহরণস্বরূপ, গুজরাট এবং হিমাচল প্রদেশে জৈব চাষের জন্য বিশেষ ভর্তুকি প্রকল্প চালু হয়েছে, যেমন গুজরাটের “সাত পাগলা খেদুত কল্যাণ” প্রকল্প, যা কৃষকদের গোমূত্র-ভিত্তিক জৈব সার তৈরির জন্য সরঞ্জাম ক্রয়ে ভর্তুকি দেয়। পশ্চিমবঙ্গেও এই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।

পরিবেশের উপর প্রভাব
গোমূত্র-ভিত্তিক জৈব কীটনাশকের ব্যবহার পরিবেশের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। রাসায়নিক কীটনাশক জলাশয়ে প্রবাহিত হয়ে জল দূষণ করে এবং জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীদের ক্ষতি করে। এছাড়াও, এটি মাটির উপকারী অণুজীব এবং জৈব বৈচিত্র্যের ক্ষতি করে। গোমূত্র-ভিত্তিক কীটনাশক এই সমস্যাগুলি হ্রাস করে এবং টেকসই কৃষি প্রচার করে। এটি মাটির জৈব কার্বনের মাত্রা বাড়ায় এবং দীর্ঘমেয়াদে মাটির স্বাস্থ্য বজায় রাখে।

পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা গোমূত্র-ভিত্তিক জৈব কীটনাশক ব্যবহার করে উৎপাদন খরচ কমাচ্ছেন এবং টেকসই কৃষির পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। এই পদ্ধতি শুধু অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়, বরং পরিবেশ এবং মানব স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ। সরকারি উদ্যোগ, প্রশিক্ষণ, এবং জৈব পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে এই প্রচেষ্টাকে আরও শক্তিশালী করা যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের এই উদ্যোগ ভারতের জৈব চাষ আন্দোলনের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে।