বেতন কমিশন কি ইউনিফর্ম সিভিল কোড কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করবে?

কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী এবং পেনশনভোগীদের জন্য বেতন ও ভাতার সংশোধনের জন্য গঠিত ৮ম বেতন কমিশন (8th Pay Commission) নিয়ে উৎসাহ তুঙ্গে। ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি…

Will 8th Pay Commission Include UCC Employees? Experts Analyze Pay Parity and Scope

কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী এবং পেনশনভোগীদের জন্য বেতন ও ভাতার সংশোধনের জন্য গঠিত ৮ম বেতন কমিশন (8th Pay Commission) নিয়ে উৎসাহ তুঙ্গে। ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হতে যাওয়া এই কমিশন প্রায় ৫০ লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এবং ৬৫ লক্ষ পেনশনভোগীদের জন্য বেতন বৃদ্ধি, নতুন ভাতা এবং পেনশন সংশোধনের সুপারিশ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে, একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসছে—এই কমিশন কি ইউনিফর্ম সিভিল কোড (UCC Employees) এর আওতায় থাকা কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করবে? এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করছেন, এবং ভারতের বেতন সমতার বিষয়টিও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।

৮ম বেতন কমিশনের পরিধি
৮ম বেতন কমিশন, যা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ২০২৫ সালের ১৬ জানুয়ারি অনুমোদন করেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের বেতন কাঠামো, ভাতা এবং পেনশন সংশোধনের জন্য গঠিত হয়েছে। এই কমিশনের সুপারিশগুলি সাধারণত কেন্দ্রীয় সরকারের সিভিল এবং প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য হয়, যারা ভারতের সংযুক্ত তহবিল থেকে বেতন পান। তবে, ইউনিফর্ম সিভিল কোড (ইউসিসি) কর্মীদের ক্ষেত্রে এই কমিশনের প্রয়োগ নিয়ে এখনও স্পষ্টতা নেই। ইউসিসি, যা ভারতের সংবিধানের ৪৪ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখিত, বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার এবং দত্তক গ্রহণের মতো ব্যক্তিগত আইনের ক্ষেত্রে সমতা আনার লক্ষ্যে প্রণীত। তবে, এই কোডের আওতায় কোনও নির্দিষ্ট কর্মী গোষ্ঠী বা প্রশাসনিক কাঠামো এখনও সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়নি।

   

বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউসিসি-র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মীরা যদি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে কাজ করেন এবং তাদের বেতন সংযুক্ত তহবিল থেকে প্রদান করা হয়, তবে তারা ৮ম বেতন কমিশনের আওতায় আসতে পারেন। তবে, যদি ইউসিসি-র বাস্তবায়নের জন্য পৃথক রাজ্য-ভিত্তিক প্রশাসনিক ইউনিট গঠন করা হয়, তবে তাদের বেতন কাঠামো রাজ্য সরকারের নীতির উপর নির্ভর করতে পারে, যা কেন্দ্রীয় বেতন কমিশনের আওতার বাইরে থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, উত্তরাখণ্ড এবং উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলি ইউসিসি বাস্তবায়নের কথা বলেছে, কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় জড়িত কর্মীদের বেতন কাঠামো এখনও স্পষ্ট নয়।

বেতন সমতার বিষয়
ইউসিসি-র সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের বেতন সমতা নিয়ে আলোচনা ভারতের ক্রীড়া প্রশাসন এবং শ্রম নীতির প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ। ৮ম বেতন কমিশনের ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ১.৮৩ থেকে ২.৪৬ এর মধ্যে হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা বেতন বৃদ্ধির হার ৩০-৩৪% পর্যন্ত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ৭ম বেতন কমিশনের অধীনে ১৮,০০০ টাকা মূল বেতনের একজন কর্মচারীর বেতন ২.৪৬ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর প্রয়োগ করলে ৪৪,২৮০ টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে। তবে, ডিয়ারনেস অ্যালাউন্স (ডিএ), যা বর্তমানে মূল বেতনের ৫৫% এ দাঁড়িয়েছে, কমিশন কার্যকর হওয়ার পর শূন্যে রিসেট হবে। এই পরিবর্তন ইউসিসি-সংশ্লিষ্ট কর্মীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে, যদি তারা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইউসিসি-র বাস্তবায়ন যদি কেন্দ্রীয় স্তরে হয়, তবে এর সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের বেতন কাঠামো ৮ম বেতন কমিশনের আওতায় আসবে। তবে, রাজ্য সরকারের অধীনে ইউসিসি-সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত কর্মীরা রাজ্যের নিজস্ব বেতন নীতির আওতায় থাকতে পারেন। এটি বেতন সমতার ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, কারণ কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের কর্মচারীদের মধ্যে বেতনের পার্থক্য ইতিমধ্যেই একটি বিতর্কিত বিষয়। উদাহরণস্বরূপ, পুলিশ এবং অন্যান্য সর্বভারতীয় পরিষেবার কর্মচারীদের মধ্যে বেতন পার্থক্য নিয়ে অতীতে বিতর্ক হয়েছে, যা ৪র্থ বেতন কমিশনের সময় থেকে উঠে এসেছিল।

Advertisements

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
অর্থনীতিবিদ ডি.কে. শ্রীবাস্তবের মতে, ৮ম বেতন কমিশনের বাস্তবায়ন কেন্দ্রীয় সরকারের উপর প্রায় ১.৮ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক বোঝা চাপিয়ে দেবে। এই ব্যয় বেতন বৃদ্ধি, ভাতা এবং পেনশন সংশোধনের জন্য বরাদ্দ করা হবে। তবে, ইউসিসি-র সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করা হলে এই ব্যয় আরও বাড়তে পারে। শ্রীবাস্তব বলেন, “ইউসিসি যদি কেন্দ্রীয় স্তরে একটি পৃথক প্রশাসনিক কাঠামোর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়, তবে এর সঙ্গে জড়িত কর্মীদের বেতন কাঠামো ৮ম বেতন কমিশনের আওতায় আনা সম্ভব। তবে, এটি সরকারের নীতি এবং ইউসিসি-র বাস্তবায়নের কাঠামোর উপর নির্ভর করবে।”

এছাড়া, ন্যাশনাল কাউন্সিল-জয়েন্ট কনসালটেটিভ মেকানিজম (এনসি-জেসিএম)-এর সদস্যরা জানিয়েছেন, তারা ২.৫৭ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টরের দাবি জানিয়েছেন, যা ৭ম বেতন কমিশনের সময় ব্যবহৃত হয়েছিল। তবে, সরকার ১.৮ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টরের দিকে ঝুঁকতে পারে, যা বেতন বৃদ্ধির হারকে কিছুটা কমিয়ে দেবে। এই ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ইউসিসি কর্মীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে, যদি তারা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকে।

সম্ভাব্য প্রভাব
ইউসিসি কর্মীদের ৮ম বেতন কমিশনের আওতায় আনা হলে, এটি ভারতের ক্রীড়া প্রশাসন এবং সামাজিক সমতার ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে, এটি রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা বাড়াবে। উত্তরাখণ্ডের মতো রাজ্য, যেখানে ইউসিসি বাস্তবায়নের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে কর্মীদের বেতন কাঠামো কেন্দ্রীয় নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা কঠিন হতে পারে। এছাড়া, আইনি বিতর্ক, যেমন শাহ বানো মামলায় দেখা গিয়েছিল, ইউসিসি-র বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

৮ম বেতন কমিশন কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে, ইউনিফর্ম সিভিল কোডের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের এর আওতায় আনা হবে কিনা, তা নির্ভর করবে সরকারের নীতি এবং প্রশাসনিক কাঠামোর উপর। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কেন্দ্রীয় স্তরে ইউসিসি বাস্তবায়ন হলে, এর সঙ্গে জড়িত কর্মীরা ৮ম বেতন কমিশনের সুবিধা পাবেন। তবে, এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য সরকারের অফিসিয়াল বিজ্ঞপ্তি এবং কমিশনের সুপারিশের অপেক্ষায় থাকতে হবে। এই কমিশন শুধু বেতন বৃদ্ধিই নয়, ভারতের ক্রীড়া প্রশাসন এবং সামাজিক সমতার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।