তৃণমূল কংগ্রেসের (টিএমসি) সিনিয়র সাংসদ এবং লোকসভার প্রধান হুইপ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় (Kalyan)তাঁর পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন, যা দলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপানউতোরের কারণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক মহল। যদিও দলের তরফে এখনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয়নি।
কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি শ্রীরামপুরের সাংসদ এবং দলের প্রতিষ্ঠাতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী, সম্প্রতি দলের অন্যান্য সাংসদদের সঙ্গে বিতর্কিত ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁর এই ইস্তফা দলের অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠী কোন্দল এবং আসন্ন ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইস্তফার প্রেক্ষাপট
কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইস্তফার পেছনে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং তাঁর বিতর্কিত আচরণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সম্প্রতি, তিনি তৃণমূলের অন্যান্য সাংসদ, বিশেষ করে মহুয়া মৈত্র এবং কীর্তি আজাদের সঙ্গে জনসমক্ষে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। এই বিরোধ নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ে একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে শুরু হয়।
মহুয়া মৈত্রের নাম স্বাক্ষরকারীদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এই ঘটনায় কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে তিনি মহুয়ার প্রতি অসম্মানজনক আচরণ করেছেন এবং এমনকি তাঁকে গ্রেফতারের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এই ঘটনার পর তৃণমূলের সিনিয়র সাংসদ সৌগত রায় কল্যাণের আচরণকে “অসভ্য” বলে সমালোচনা করে তাঁর প্রধান হুইপ পদ থেকে অপসারণের দাবি জানান।
কল্যাণের বিতর্কিত ইতিহাস
কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর আগেও তাঁর বিতর্কিত মন্তব্য এবং আচরণের জন্য শিরোনামে এসেছেন। ২০২৪ সালের অক্টোবরে, ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল নিয়ে যৌথ সংসদীয় কমিটির বৈঠকে তিনি একটি কাচের বোতল ভেঙে চেয়ারম্যান জগদম্বিকা পালের দিকে ছুঁড়ে মারেন বলে অভিযোগ ওঠে।
যার জন্য তাঁকে একদিনের জন্য কমিটি থেকে সাসপেন্ড করা হয়। এছাড়া, তিনি রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড়কে উপহাস করে এবং বিজেপি সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর এই ধরনের আচরণ দলের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
দলের অভ্যন্তরীণ গতিশীলতা
কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইস্তফা তৃণমূল কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ বিভেদকে আরও স্পষ্ট করেছে। তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হলেও, তাঁর সাম্প্রতিক আচরণ দলের অন্যান্য সাংসদদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। সৌগত রায় বলেন, “কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আচরণ দলের জন্য ক্ষতিকর।
তাঁর এই ধরনের ব্যবহার নারী সাংসদদের প্রতি অসম্মানজনক।” এই পরিস্থিতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে দলের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তিনি ইতিমধ্যেই সাংসদদের সতর্ক করে বলেছেন যেন দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলি জনসমক্ষে আলোচনা না করা হয়।
রাজনৈতিক প্রভাব
কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইস্তফা তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য একটি সংকটের মুহূর্তে এসেছে, যখন দলটি ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাঁর ইস্তফা দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্যের উপর প্রশ্ন তুলেছে। বিজেপি এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে উসকে দিয়েছে, বিশেষ করে বিজেপির আইটি সেল প্রধান অমিত মালব্য সামাজিক মাধ্যমে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মহুয়া মৈত্রের তর্কের ভিডিও এবং হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের স্ক্রিনশট শেয়ার করেছেন।
কল্যাণের ভবিষ্যৎ
কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূল কংগ্রেসের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আইনি কৌশলের প্রধান স্তম্ভ। তিনি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন থেকে শুরু করে দলের বিভিন্ন মামলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
তবে, তাঁর সাম্প্রতিক আচরণ এবং ইস্তফা তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তিনি বলেছেন, “আমি দিদির (মমতা) জন্য দলে আছি। তিনি না থাকলে আমিও থাকব না।” এই মন্তব্য তাঁর মমতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেও, দলের অভ্যন্তরীণ চাপ তাঁর অবস্থানকে জটিল করে তুলেছে।
কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লোকসভার প্রধান হুইপ পদ থেকে ইস্তফা তৃণমূল কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ সংকটের একটি প্রতিফলন। তাঁর বিতর্কিত আচরণ এবং দলের সাংসদদের সঙ্গে সংঘাত দলের ঐক্যের উপর প্রভাব ফেলেছে।
ডানা ছাঁটল উত্তর কলকাতার সাংসদের? লোকসভার নেতৃত্বে বড় মুখ
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য এখন চ্যালেঞ্জ হলো দলের শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা এবং আসন্ন নির্বাচনের জন্য দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা। এই ঘটনা তৃণমূলের জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা এবং দলের অভ্যন্তরীণ গতিশীলতার উপর নতুন করে আলোকপাত করেছে।