ভারতের কৃষি খাত দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। প্রায় ৭০% গ্রামীণ জনগোষ্ঠী তাদের জীবিকার জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল। তবে, অপ্রতুল প্রযুক্তি, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং বাজারে প্রবেশের অভাবের মতো চ্যালেঞ্জের কারণে কৃষকরা প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হন। এই পরিস্থিতিতে, তরুণ কৃষি উদ্যোক্তারা নতুন প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে কৃষি খাতে বিপ্লব ঘটাচ্ছেন। ভারত সরকার তাদের উৎসাহিত করতে এবং কৃষি-ভিত্তিক স্টার্টআপকে প্রচার (Farming Yojanas) করতে বেশ কিছু যোজনা চালু করেছে। ২০২৫ সালে তরুণ কৃষি উদ্যোক্তাদের জন্য সবচেয়ে কার্যকর তিনটি যোজনা হলো: ইনোভেশন অ্যান্ড অ্যাগ্রি-এন্ট্রাপ্রেনারশিপ ডেভেলপমেন্ট স্কিম (রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনা – RAFTAAR), অ্যাগ্রি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফান্ড (AIF), এবং অ্যাগ্রি সিড ফান্ডিং স্কিম। এই প্রতিবেদনে আমরা এই তিনটি যোজনার বিশদ বিবরণ এবং তরুণ কৃষি উদ্যোক্তাদের জন্য এর সুবিধাগুলো বিশ্লেষণ করব।
১. ইনোভেশন অ্যান্ড অ্যাগ্রি-এন্ট্রাপ্রেনারশিপ ডেভেলপমেন্ট স্কিম (RKVY-RAFTAAR)
রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনা (RKVY)-এর অধীনে চালু হওয়া ইনোভেশন অ্যান্ড অ্যাগ্রি-এন্ট্রাপ্রেনারশিপ ডেভেলপমেন্ট স্কিম তরুণ কৃষি উদ্যোক্তাদের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই যোজনার মূল উদ্দেশ্য হলো কৃষি এবং সংশ্লিষ্ট খাতে উদ্ভাবনী স্টার্টআপগুলোকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করা। এই স্কিমের মাধ্যমে স্টার্টআপগুলোকে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সিড ফান্ডিং দেওয়া হয়, যা মিনিমাম ভায়েবল প্রোডাক্ট (MVP) তৈরি থেকে বাজারে প্রবেশ পর্যন্ত সহায়ক।
বৈশিষ্ট্য:
আর্থিক সহায়তা: স্টার্টআপগুলোকে সিড ফান্ডিং হিসেবে ৫ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এই তহবিল প্রযুক্তি-ভিত্তিক সমাধান, পণ্য, বা ব্যবসায়িক মডেলের উন্নয়নের জন্য ব্যবহৃত হয়।
ইনকিউবেশন সমর্থন: দেশজুড়ে ২৪টি RKVY-RAFTAAR অ্যাগ্রিবিজনেস ইনকিউবেটর (R-ABIs) তরুণ উদ্যোক্তাদের মেন্টরশিপ, প্রশিক্ষণ, এবং নেটওয়ার্কিং সুবিধা প্রদান করে।
যোগ্যতা: স্টার্টআপকে DPIIT-র অধীনে নিবন্ধিত হতে হবে এবং R-ABI-তে কমপক্ষে দুই মাসের রেসিডেন্সি থাকতে হবে।
প্রভাব: এই স্কিমের মাধ্যমে স্টার্টআপ যেমন DeHaat এবং Agrowave তাদের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করেছে এবং কৃষকদের আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে।
এই যোজনা তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী কারণ এটি কেবল আর্থিক সহায়তাই নয়, বরং প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং বাজারে প্রবেশের সুযোগ প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ, মহারাষ্ট্রের সচিন কালে তার “ইনোভেটিভ অ্যাগ্রিলাইফ সলিউশনস” নামক স্টার্টআপের মাধ্যমে ইন্টিগ্রেটেড ফার্মিং সিস্টেম প্রবর্তন করেছেন, যা কৃষি, মৎস্য, এবং পোলট্রি সমন্বিত করে টেকসই কৃষি মডেল তৈরি করেছে।

২. অ্যাগ্রি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফান্ড (AIF)
২০২০ সালের ১৫ মে ঘোষিত অ্যাগ্রি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফান্ড (AIF) কৃষি উদ্যোক্তাদের জন্য পোস্ট-হার্ভেস্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার উন্নয়নে ১ লাখ কোটি টাকার তহবিল প্রদান করে। এই যোজনা ২০২০-২১ থেকে ২০৩২-৩৩ পর্যন্ত কার্যকর থাকবে এবং কৃষক, কৃষি উদ্যোক্তা, এবং স্টার্টআপদের জন্য ফার্ম-গেট ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরিতে সহায়তা করে।
বৈশিষ্ট্য:
আর্থিক সহায়তা: প্রতি প্রকল্পে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণের উপর ৩% সুদে ভর্তুকি দেওয়া হয়, যা ৭ বছর পর্যন্ত প্রযোজ্য।
ক্রেডিট গ্যারান্টি: ২ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণের জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি প্রদান করা হয়, যা স্টার্টআপদের জন্য ঋণ গ্রহণকে ঝুঁকিমুক্ত করে।
লক্ষ্য: কোল্ড স্টোরেজ, গুদাম, এবং লজিস্টিক সুবিধা তৈরি করে পোস্ট-হার্ভেস্ট ক্ষতি কমানো এবং কৃষকদের জন্য ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা।
প্রভাব: এই তহবিল কৃষি স্টার্টআপ যেমন Agrowave-কে তাদের লজিস্টিক ফ্রেমওয়ার্ক সম্প্রসারণে সহায়তা করেছে, যা কৃষকদের বাজারে সরাসরি প্রবেশের সুযোগ দিয়েছে।
তরুণ উদ্যোক্তারা এই তহবিল ব্যবহার করে কোল্ড স্টোরেজ, গুদাম, এবং প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট স্থাপন করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, কৌশলেন্দ্রের কৌশল্য ফাউন্ডেশন কোল্ড চেইন লজিস্টিক মডেল তৈরি করে কৃষকদের পোস্ট-হার্ভেস্ট ক্ষতি কমাতে এবং বাজারে প্রবেশের সুযোগ দিতে এই তহবিল ব্যবহার করেছে।
৩. অ্যাগ্রি সিড ফান্ডিং স্কিম
২০২৫ সালের জন্য অ্যাগ্রি সিড ফান্ডিং স্কিম তরুণ কৃষি উদ্যোক্তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। এই স্কিমের অধীনে DPIIT-নিবন্ধিত স্টার্টআপগুলো ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সিড ফান্ডিং পেতে পারে। এই তহবিল কৃষি ও সংশ্লিষ্ট খাতে উদ্ভাবনী সমাধান তৈরির জন্য প্রদান করা হয়।
বৈশিষ্ট্য:
আর্থিক সহায়তা: সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা সিড ফান্ডিং, যা ইকুইটি হ্রাস ছাড়াই পাওয়া যায়।
মেন্টরশিপ এবং নেটওয়ার্কিং: স্টার্টআপগুলো বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে মেন্টরশিপ এবং বিনিয়োগকারীদের সাথে নেটওয়ার্কিং সুবিধা পায়।
যোগ্যতা: স্টার্টআপকে DPIIT-নিবন্ধিত হতে হবে এবং আবেদনের সময়সীমা ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫।
প্রভাব: এই স্কিম কৃষি প্রযুক্তি স্টার্টআপ যেমন Reshamandi-কে তাদের AI এবং IoT-ভিত্তিক সমাধানের মাধ্যমে কৃষকদের আয় বাড়াতে সহায়তা করেছে।
এই স্কিম তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য প্রাথমিক মূলধন সরবরাহ করে, যা তাদের উদ্ভাবনী ধারণাগুলোকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, Reshamandi সিল্ক সাপ্লাই চেইনকে ডিজিটাইজ করে কৃষকদের জন্য ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করেছে।
তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সুবিধা
এই তিনটি যোজনা তরুণ কৃষি উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ:
আর্থিক সহায়তা: সিড ফান্ডিং এবং সুদে ভর্তুকি তরুণদের প্রাথমিক মূলধনের ঝুঁকি কমায়।
প্রযুক্তিগত উন্নয়ন: প্রিসিশন ফার্মিং, AI, এবং IoT-এর মতো প্রযুক্তি গ্রহণে সহায়তা করে।
বাজারে প্রবেশ: কৃষকদের সরাসরি বাজারে সংযোগ স্থাপন করে এবং পোস্ট-হার্ভেস্ট ক্ষতি কমায়।
মেন্টরশিপ: ইনকিউবেশন সেন্টার এবং বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে ব্যবসায়িক দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
উদাহরণ এবং প্রভাব
এই যোজনাগুলো ইতিমধ্যে বেশ কিছু সফল স্টার্টআপ তৈরি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, CropIn, একটি SaaS-ভিত্তিক অ্যাগ্রিটেক প্ল্যাটফর্ম, RKVY-RAFTAAR-এর সহায়তায় ১৬ মিলিয়ন একর জমির ডিজিটাইজেশন করেছে এবং ৭ মিলিয়ন কৃষকের জীবনযাত্রায় উন্নতি এনেছে। এছাড়া, Fasal নামক স্টার্টআপ IoT-ভিত্তিক সমাধানের মাধ্যমে ৩ বিলিয়ন লিটার পানি সাশ্রয় করেছে। এই সাফল্যগুলো তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য প্রেরণা।
চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
এই যোজনাগুলোর সুবিধা থাকলেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন, DPIIT নিবন্ধনের প্রক্রিয়া জটিল হতে পারে, এবং গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। তবে, স্টার্টআপ ইন্ডিয়া এবং এগনিওলের মতো প্ল্যাটফর্ম এই প্রক্রিয়াকে সহজ করছে। তরুণদের উচিত সরকারি পোর্টাল যেমন PM-KISAN, NABARD, এবং e-NAM-এর মাধ্যমে আবেদন করা এবং প্রয়োজনীয় নথি (আধার কার্ড, জমির মালিকানা প্রমাণ, ব্যাঙ্ক বিবরণ) প্রস্তুত রাখা।
২০২৫ সালে তরুণ কৃষি উদ্যোক্তাদের জন্য RKVY-RAFTAAR, অ্যাগ্রি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফান্ড, এবং অ্যাগ্রি সিড ফান্ডিং স্কিম হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যোজনা। এই স্কিমগুলো আর্থিক সহায়তা, মেন্টরশিপ, এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষি খাতে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। তরুণরা এই সুযোগগুলোর সদ্ব্যবহার করে কৃষি-ভিত্তিক স্টার্টআপ শুরু করতে পারেন এবং দেশের কৃষি অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারেন। সরকারের এই উদ্যোগগুলো ভারতকে কৃষি প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশ্ব নেতৃত্বে নিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করছে।