Landslides in North Benga: উত্তরবঙ্গের নদীগুলো, বিশেষ করে তিস্তা এবং জলঢাকা, অবিরাম বৃষ্টির কারণে ফুঁসে উঠেছে। এই ভারী বর্ষণ নিম্নাঞ্চলগুলোতে বন্যার সৃষ্টি করেছে এবং সিকিম ও কালিম্পং-এর সঙ্গে সড়ক যোগাযোগে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তর (আইএমডি) জানিয়েছে, উপ-হিমালয় অঞ্চলের জেলাগুলোতে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে, যার মধ্যে কিছু জায়গায় প্রবল বর্ষণ হতে পারে।
জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার মাধ্যমে প্রবাহিত তিস্তা নদীর জলস্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় রাজ্যের সেচ বিভাগ জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহারের কিছু অংশে ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করেছে। জলঢাকা নদীতেও জলস্তর বিপদসীমা ছুঁয়েছে, এবং নদীটির তীরবর্তী এলাকাগুলোর জন্য ‘ইয়েলো অ্যালার্ট’ জারি করা হয়েছে। তরকোলায় রাতভর ভারী বৃষ্টির কারণে একটি ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে, যা সিকিমের সঙ্গে শিলিগুড়িকে সংযোগকারী জাতীয় সড়ক ১০-এ যান চলাচলে মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করেছে। এই মহাসড়কটি সিকিম ও উত্তরবঙ্গের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগসূত্র, এবং এর বন্ধ থাকার ফলে পর্যটক এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়েছে।
আইএমডি-র পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২ থেকে ৪ আগস্টের মধ্যে উত্তরবঙ্গ এবং সিকিমে ২০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে। এই বৃষ্টি তিস্তা ও জলঢাকার মতো নদীগুলোর জলস্তর আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা বন্যার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। সিকিম থেকে আসা পলিমাটি ও ধ্বংসাবশেষে তিস্তার নদীতট উঁচু হয়ে গেছে, যা ২০২৩ সালের অক্টোবরের বিধ্বংসী বন্যার পর থেকে নদীর প্রবাহকে আরও বিপজ্জনক করে তুলেছে। স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, তিস্তা নদীর উপর নির্মিত ৪৭টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং ১৪টি রেল টানেল নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে, যা পলি জমা এবং নদীতটের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কালিম্পং জেলার তিস্তা বাজার এলাকায় নদীর জল রাস্তায় উঠে এসেছে, যার ফলে জাতীয় সড়ক ১০-এর কিছু অংশ ডুবে গেছে। এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি বাড়ি ও সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। জলপাইগুড়ির নিম্নাঞ্চলগুলো, যেমন মালবাজার, ময়নাগুড়ি এবং ধূপগুড়ি, তিস্তা ও জলঢাকার জলস্তর বৃদ্ধির কারণে বন্যার কবলে পড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় শিলিগুড়িতে ২৭৪.৬ মিলিমিটার, মালবাজারে ২৫৮.৫ মিলিমিটার এবং সেবক-এ ২০৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
স্থানীয় প্রশাসন এবং জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী (এনডিআরএফ) ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ ও উদ্ধারকাজ পরিচালনা করছে। তিস্তা নদীর তীরে বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার জন্য জরুরি নির্দেশ জারি করা হয়েছে। সিকিমের সঙ্গে সংযোগকারী জাতীয় সড়ক ১০-এর বন্ধ থাকার কারণে পর্যটক এবং স্থানীয় বাসিন্দারা আটকে পড়েছেন। সিকিমের মানগান জেলায় ইতিমধ্যে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ১,৫০০-এর বেশি পর্যটক আটকে রয়েছেন।
পরিবেশবিদরা দীর্ঘদিন ধরে তিস্তা নদীর উপর অতিরিক্ত নির্মাণ কার্যক্রমের বিষয়ে সতর্ক করে আসছেন। শিলিগুড়ির হিমালয়ান নেচার ফাউন্ডেশনের অনিমেষ বসু বলেন, “তিস্তা নদীর তীরে নিয়ন্ত্রণহীন উন্নয়ন কাজ, যেমন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং রেল টানেল, নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে। এর ফলে পলি জমা হচ্ছে এবং নদীতট উঁচু হচ্ছে, যা শিলিগুড়ি ও জলপাইগুড়ির মতো নিম্নাঞ্চলের শহরগুলোর জন্য ভবিষ্যতে বন্যার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।”
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন এবং ত্রাণ কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সব ধরনের সহায়তা প্রদান করছি, যার মধ্যে রয়েছে ত্রাণ শিবির, অস্থায়ী আশ্রয় এবং মৌলিক চাহিদা পূরণ।” এদিকে, জলপাইগুড়ির জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্মরাকি মহাপাত্র জানিয়েছেন, তিস্তার উপরের অববাহিকায় বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে জলপাইগুড়ি শহরে বন্যার ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে।
এই পরিস্থিতি উত্তরবঙ্গের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বন্যা ও ভূমিধসের প্রভাব কমানোর চেষ্টা চলছে। তবে, দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ পুনরুদ্ধার এবং অতিরিক্ত নির্মাণ নিয়ন্ত্রণের দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি।