ভারতের কৃষকদের জন্য কিষাণ রেল স্কিম (Kisan Rail Scheme) একটি গেম-চেঞ্জার হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে, যা কৃষি পণ্য, বিশেষ করে ফল ও সবজির পরিবহনকে সহজতর করেছে। ২০২০ সালের ৭ আগস্ট দেবলালি (মহারাষ্ট্র) থেকে দানাপুর (বিহার) পর্যন্ত প্রথম কিষাণ রেল চালু হওয়ার পর থেকে এই স্কিম কৃষকদের বড় এবং লাভজনক বাজারে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে। জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত, ভারতীয় রেলওয়ে নতুন রুট চালু করেছে এবং ভর্তুকির সুবিধা সম্প্রসারিত করেছে। এই নিবন্ধে আমরা কিষাণ রেলের সর্বশেষ আপডেট, নতুন রুট, ভর্তুকির সুবিধা এবং সবজি পরিবহনের ক্ষেত্রে এর প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
কিষাণ রেল স্কিম: একটি ওভারভিউ
কিষাণ রেল ২০২০-২১ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে ঘোষিত একটি উদ্যোগ, যার লক্ষ্য ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য সাশ্রয়ী এবং দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এই স্কিমের মাধ্যমে ফল, সবজি, দুগ্ধজাত পণ্য, মাছ, মাংস এবং ফুলের মতো পচনশীল পণ্য উৎপাদন এলাকা থেকে বড় শহর এবং বাজারে পরিবহন করা হয়। এটি মাল্টি-কমোডিটি, মাল্টি-কনসাইনর, মাল্টি-কনসাইনি এবং মাল্টি-স্টপেজের নীতির উপর ভিত্তি করে কাজ করে, যা কৃষকদের মধ্যস্থতাকারী ছাড়াই তাদের পণ্য পরিবহনের সুযোগ দেয়। কোনো ন্যূনতম পরিমাণের সীমাবদ্ধতা না থাকায় ক্ষুদ্র কৃষকরা সহজেই এই সেবা ব্যবহার করতে পারেন।
জুলাই ২০২৫-এর নতুন রুট আপডেট
জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত, ভারতীয় রেলওয়ে কিষাণ রেলের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করেছে, নতুন রুট যুক্ত করে কৃষকদের জন্য আরও বাজারের সুযোগ তৈরি করেছে। যদিও সুনির্দিষ্ট নতুন রুটের তালিকা জুলাই ২০২৫-এর জন্য সরকারিভাবে প্রকাশিত হয়নি, সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিম্নলিখিত
এলাকাগুলোতে নতুন রুট চালু হয়েছে বা প্রস্তাবিত হয়েছে:
মধ্যপ্রদেশ থেকে দিল্লি এনসিআর: মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র এবং ভোপালের মতো কৃষি-কেন্দ্রিক অঞ্চল থেকে দিল্লি এবং আশপাশের বাজারে সবজি এবং ফল পরিবহনের জন্য নতুন সার্ভিস।
উত্তর প্রদেশ থেকে পূর্ব ভারত: উত্তর প্রদেশের বারাণসী এবং লখনউ থেকে কলকাতা এবং গৌহাটির মতো পূর্বাঞ্চলীয় শহরগুলোতে সংযোগ।
পাঞ্জাব থেকে দক্ষিণ ভারত: পাঞ্জাবের ফল ও সবজি, যেমন আলু এবং কিনো, চেন্নাই এবং বেঙ্গালুরুর মতো দক্ষিণের বাজারে পৌঁছানোর জন্য নতুন রুট।
আন্দামান ও নিকোবর থেকে মূল ভূখণ্ড: দ্বীপপুঞ্জের কৃষকদের জন্য কলকাতা এবং চেন্নাইয়ের বাজারে ফল ও মাছ পরিবহনের জন্য বিশেষ সার্ভিস।
এই নতুন রুটগুলো কৃষি উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে বড় শহর এবং রপ্তানি বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করছে, যা কৃষকদের আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক। ভারতীয় রেলওয়ে রাজ্য সরকার, কৃষি বিপণন কমিটি (এপিএমসি) এবং কৃষক উৎপাদক সংগঠন (এফপিও)-এর সঙ্গে সমন্বয় করে এই রুটগুলো চালু করছে।
ভর্তুকির সুবিধা: সবজি পরিবহনে সহায়তা
কিষাণ রেলের অন্যতম বড় আকর্ষণ হলো ফল ও সবজি পরিবহনের জন্য ৫০% ভর্তুকি, যা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প মন্ত্রণালয় (MoFPI) অপারেশন গ্রিনস – টপ টু টোটাল স্কিমের অধীনে প্রদান করে। এই ভর্তুকির মাধ্যমে কৃষকদের মালবাহী খরচের মাত্র অর্ধেক দিতে হয়, যা তাদের পরিবহন ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে।
জুলাই ২০২৫-এর আপডেট অনুযায়ী:
- ভর্তুকির সম্প্রসারণ: প্রাথমিকভাবে শুধুমাত্র টমেটো, পেঁয়াজ এবং আলু (TOP) সহ নির্দিষ্ট ফল ও সবজির জন্য ভর্তুকি দেওয়া হতো। তবে, কৃষকদের চাহিদা এবং স্কিমের জনপ্রিয়তার কারণে, এখন সব ধরনের ফল ও সবজির জন্য এই ভর্তুকি প্রযোজ্য। এর মধ্যে রয়েছে আম, কলা, পেয়ারা, কিউই, লিচু, পেঁপে, মৌসুমি, কমলা, আনারস, জ্যাকফ্রুট, আপেল, ফরাসি বিন, ব্রিনজাল, গাজর, ফুলকপি, শসা, মটরশুটি, রসুন, পেঁয়াজ, আলু, টমেটো, আদা, ক্যাপসিকাম এবং আরও অনেক কিছু।
- অর্থনৈতিক সুবিধা: ভর্তুকির ফলে প্রতি টন পরিবহন খরচ গড়ে ১০০০ টাকা কমে, এবং রেল পরিবহন রাস্তার তুলনায় ১৫ ঘণ্টা সময় বাঁচায়। এটি কৃষকদের পণ্যের গুণমান বজায় রেখে বড় বাজারে পৌঁছাতে সহায়তা করে।
- অন্যান্য পচনশীল পণ্য: ফল ও সবজি ছাড়াও, ফুল, ডিম, দুগ্ধজাত পণ্য এবং মাছের পরিবহনেও এই ভর্তুকি প্রযোজ্য, যা কৃষকদের আয়ের নতুন উৎস তৈরি করছে।
কিষাণ রেলের প্রভাব এবং পরিসংখ্যান
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, ভারতীয় রেলওয়ে ২,৩৫৯টি কিষাণ রেল পরিচালনা করেছে, যা ৭.৯ লক্ষ টন পচনশীল পণ্য পরিবহন করেছে। মহারাষ্ট্রে ১,৮৩৮টি, উত্তর প্রদেশে ৭৬টি, পশ্চিমবঙ্গে ৫৯টি, এবং তেলেঙ্গানায় ৬৬টি সার্ভিস পরিচালিত হয়েছে। ২০২৫ সালে এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যদিও সঠিক পরিসংখ্যান জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি।
নাসিক, নিউ আজাদপুর, সিঙ্গুর, বারাণসী, গাজীপুর এবং ফতুহায় তাপমাত্রা-নিয়ন্ত্রিত পচনশীল পণ্য কেন্দ্র (পেরিশেবল কার্গো সেন্টার) স্থাপন করা হয়েছে, যা পণ্যের গুণমান বজায় রাখতে সহায়ক। এছাড়া, কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র (কেভিকে) এবং কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কৃষকদের মধ্যে এই স্কিম সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
কিষাণ রেল স্কিম সফল হলেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
- প্যাকেজিং এবং লোডিং-আনলোডিং: এই প্রক্রিয়ায় সময় নষ্ট এবং পণ্যের ক্ষতি হওয়ার সমস্যা রয়েছে।
- শীতল সংরক্ষণ অবকাঠামো: আরও উন্নত শীতল সংরক্ষণ সুবিধার প্রয়োজন, যাতে পণ্যের ক্ষতি কমানো যায়।
- সচেতনতার অভাব: অনেক কৃষক এখনও এই স্কিম সম্পর্কে অবগত নন। কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র এবং এফপিও-এর মাধ্যমে আরও প্রচার প্রয়োজন।
ভবিষ্যতে, ভারতীয় রেলওয়ে ই-ন্যাশনাল এগ্রিকালচার মার্কেট (ই-ন্যাম) এর সঙ্গে কিষাণ রেলের সমন্বয় এবং আরও রেফ্রিজারেটেড কোচ যুক্ত করার পরিকল্পনা করছে। এছাড়া, কৃষি উড়ান স্কিমের সঙ্গে সমন্বয় করে উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দ্বীপপুঞ্জের কৃষকদের জন্য পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করা হচ্ছে।
কিষাণ রেল স্কিম ভারতের কৃষকদের জন্য একটি বিপ্লবী উদ্যোগ, যা তাদের পণ্য বড় বাজারে পৌঁছানোর সুযোগ দিচ্ছে। জুলাই ২০২৫-এর নতুন রুট এবং সম্প্রসারিত ভর্তুকি সুবিধা কৃষকদের আয় বৃদ্ধি এবং কৃষি বর্জ্য হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে, শীতল সংরক্ষণ অবকাঠামোর উন্নতি এবং কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই স্কিমকে আরও কার্যকর করা যেতে পারে। কিষাণ রেল কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার সরকারি লক্ষ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করছে।