কলকাতার তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদিও কলকাতার (Kolkata) আইটি শিল্প গত কয়েক বছরে ৭০% বার্ষিক বৃদ্ধির হার অর্জন করেছে, তবুও অনেক টেক কর্মী (IT Employee) শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। এই প্রবণতা, যা “কলকাতা রিজিগনেশন ট্রেন্ড” নামে পরিচিত, ক্ষুদ্র ও বৃহৎ আইটি সংস্থাগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টিসিএস, ইনফোসিস, উইপ্রোর মতো শীর্ষস্থানীয় সংস্থাগুলো থেকে শুরু করে স্টার্টআপ পর্যন্ত, কর্মীদের চলে যাওয়ার এই প্রবণতা শিল্পের গতিশীলতাকে প্রভাবিত করছে। নিম্নে ২০২৫ সালে কলকাতা থেকে টেক কর্মীদের চলে যাওয়ার শীর্ষ ৫টি কারণ উল্লেখ করা হলো।
১. ক্যারিয়ার বৃদ্ধির সীমিত সুযোগ
কলকাতার আইটি খাত দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও, বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ বা পুনের মতো শহরের তুলনায় উচ্চ-স্তরের প্রকল্প এবং নেতৃত্বের ভূমিকার সুযোগ এখনও সীমিত। টিমলিজ ডিজিটালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২৫% আইটি পেশাদার মনে করেন যে ক্যারিয়ার বৃদ্ধির অভাব তাদের চাকরি ছাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ। কলকাতায় বড় আইটি সংস্থাগুলোর শাখা থাকলেও, উচ্চ-প্রযুক্তির কাজ যেমন এআই, ক্লাউড কম্পিউটিং, এবং সাইবারসিকিউরিটির জন্য বিশেষায়িত ভূমিকা প্রায়শই অন্য শহরে স্থানান্তরিত হয়। ফলে, উচ্চাকাঙ্ক্ষী টেক কর্মীরা কলকাতা ছেড়ে এমন শহরে যাচ্ছেন যেখানে ক্যারিয়ারের অগ্রগতির সম্ভাবনা বেশি।
২. বেতন ও সুবিধার প্রতিযোগিতা
কলকাতার আইটি সংস্থাগুলোতে বেতন বৃদ্ধির হার গত কয়েক বছরে স্থবির হয়ে পড়েছে। ২০২০ সালে যেখানে আইটি খাতে গড় বেতন বৃদ্ধির হার ছিল ৯.৫%, তা ২০২৫ সালে নেমে এসেছে ৫.২%-এ। এদিকে, বেঙ্গালুরু, মুম্বই এবং দিল্লি-এনসিআরের মতো শহরে সংস্থাগুলো উচ্চ বেতন এবং ভালো সুবিধা প্রদান করছে। টিমলিজের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৫০% আইটি পেশাদার মনে করেন যে ভালো বেতন ও সুবিধার অভাব তাদের চাকরি ছাড়ার প্রধান কারণ। কলকাতায় জীবনযাত্রার ব্যয় তুলনামূলকভাবে কম হলেও, আইটি কর্মীরা বেশি আয়ের জন্য অন্য শহরে স্থানান্তরিত হচ্ছেন।
৩. এআই এবং অটোমেশনের প্রভাব
২০২৫ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং অটোমেশনের দ্রুত প্রসারের কারণে আইটি খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে। টিসিএস-এর মতো সংস্থাগুলো এআই-চালিত প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে, যার ফলে ম্যানুয়াল টেস্টিং, টেকনোলজি সাপোর্ট এবং সিস্টেম অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মতো কাজের চাহিদা কমছে। টিসিএস ২০২৫ সালে তাদের কর্মীবাহিনীর ২% (প্রায় ১২,০০০ কর্মী) ছাঁটাই করার পরিকল্পনা করেছে, যার মধ্যে কলকাতার কর্মীরাও রয়েছেন। এই ছাঁটাই এবং নতুন প্রযুক্তির দক্ষতার অভাবে অনেক কর্মী কলকাতা ছেড়ে এমন শহরে যাচ্ছেন যেখানে এআই, ডেটা সায়েন্স এবং সাইবারসিকিউরিটির মতো ক্ষেত্রে বেশি সুযোগ রয়েছে।
৪. ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স এবং নমনীয় কাজের সুযোগ
কোভিড-১৯ মহামারীর পর থেকে আইটি কর্মীরা ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স এবং নমনীয় কাজের পরিবেশের উপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। শেওয়ার্ক.ইন-এর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৪২% কর্মী ভালো ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স এবং রিমোট কাজের সুযোগের জন্য চাকরি ছাড়ছেন। কলকাতার অনেক আইটি সংস্থা এখনও সম্পূর্ণ রিমোট বা হাইব্রিড কাজের মডেল গ্রহণ করেনি, যেখানে বেঙ্গালুরু বা মুম্বইয়ের সংস্থাগুলো এই ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। ফলে, কর্মীরা এমন শহরে স্থানান্তরিত হচ্ছেন যেখানে রিমোট কাজের সুযোগ এবং নমনীয় নীতি রয়েছে।
৫. বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি চাহিদা এবং বিদেশে সুযোগ
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ফিউচার অফ জবস রিপোর্ট ২০২৫ অনুযায়ী, ভারতের ৬৭% সংস্থা বিভিন্ন প্রতিভা পুল থেকে কর্মী নিয়োগের পরিকল্পনা করছে, যার মধ্যে বিদেশি প্রতিভাও রয়েছে। কলকাতার টেক কর্মীরা, বিশেষ করে এআই, সাইবারসিকিউরিটি এবং ডেটা সায়েন্সে দক্ষ পেশাদাররা, বিদেশে উচ্চ বেতন এবং ক্যারিয়ার বৃদ্ধির সুযোগের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে স্থানান্তরিত হচ্ছেন। এছাড়া, কলকাতায় সেমিকন্ডাক্টর এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো উদীয়মান প্রযুক্তির সুযোগ সীমিত, যা কর্মীদের অন্যত্র যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করছে।
কলকাতার আইটি খাত যদিও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবুও ক্যারিয়ার বৃদ্ধির সীমিত সুযোগ, বেতন প্রতিযোগিতার অভাব, এআই-চালিত ছাঁটাই, ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্সের ঘাটতি এবং বিশ্বব্যাপী সুযোগের আকর্ষণের কারণে টেক কর্মীরা শহর ছাড়ছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগ যেমন ওয়েস্ট বেঙ্গল ইনফরমেশন টেকনোলজি সার্ভিসেস (WBITES) এবং ওয়েবেল কিছুটা আশার আলো দেখালেও, এই প্রবণতা ঠেকাতে আরও কার্যকর কৌশল, যেমন দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি এবং নমনীয় কাজের পরিবেশ গ্রহণ, প্রয়োজন। কলকাতাকে আইটি হাব হিসেবে টিকিয়ে রাখতে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা এখন সময়ের দাবি।