লোকসভায় পহেলগাঁও জঙ্গি হামলা ও পরবর্তী ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে আলোচনায় মঙ্গলবার আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন যাদবপুরের তৃণমূল সাংসদ সায়নী ঘোষ (Sayani Ghosh)। প্রথমবার সংসদে বক্তব্য রাখলেও তাঁর আকর্ষণীয় উপস্থিতি, কণ্ঠস্বরের ওঠানামা, হাতের মুদ্রা এবং সযত্ন শব্দচয়নে ধরা পড়ল এক দক্ষ বক্তার ছাপ।
তিন ভাষায় সাবলীল সায়নী
সাদা সুতির শাড়ি ও গাঢ় লাল টিপে সায়নী নিজের বক্তব্য শুরুতেই জানালেন, তিনি বাংলার পাশাপাশি হিন্দি ও ইংরেজিতেও কথা বলবেন। তিনটি ভাষাতেই তাঁর সাবলীল ভঙ্গি নজর কেড়েছে। কাগজ হাতে থাকলেও প্রয়োজনে কাগজ ছেড়ে চোখে চোখ রেখে বক্তব্য রাখেন তিনি।
বিজেপিকে সরাসরি আক্রমণ
পরিসংখ্যান তুলে ধরে সায়নী অভিযোগ করেন, ‘‘১০ মে থেকে আজ (২৯ জুলাই) পর্যন্ত ২৮ বার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভারত-পাক সংঘর্ষবিরতি নিয়ে তাঁর ভূমিকার কথা বলেছেন। তার পরেও ভারত সরকার প্রায় ‘নীরব’ ছিল। চুপ ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ (Rajnath Singh)।’’ সায়নীর উপহাস, ‘‘মোদীকে তাঁর জোকারে পরিণত করেছেন ট্রাম্প।’’
তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) সরকারপন্থী অবস্থান স্মরণ করিয়ে সায়নী বলেন, “মমতাদি যখন দেশের স্বার্থে সরকারের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তখন বিজেপি মন্ত্রীরা হুমকি দেন, অপারেশন সিঁদুরের পরে অপারেশন পশ্চিমবঙ্গ হবে। ক্ষমতা থাকলে কালকেই ভোট করুন, দেখা যাবে।”
বাংলায় ছড়া কেটে তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন— ‘‘এক দিকে আপনাদের সরকার, এজেন্সি আর কোটি কোটি ক্ষমতা, অন্য দিকে হাওয়াইচটি আর বাংলার মেয়ে মমতা। দেখি কে জেতে!’’
পহেলগাঁও হামলার প্রসঙ্গ
২৬ জন নিহতের মধ্যে যাদবপুরের বাসিন্দা বিতান অধিকারীর মৃত্যুর প্রসঙ্গ তুলতে গিয়ে গলা ধরে আসে সায়নীর। তার পরেই আবার পাকিস্তানের সন্ত্রাস, মোদী সরকারের ভূমিকা এবং বিজেপি-কে ক্রমাগত আক্রমণ করেন তৃণমূল সাংসদ। সায়নী মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী শুরুটা ভাল করলেও শেষটা ভাল করতে পারেননি। তৃণমূল সাংসদের প্রশ্ন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী কি পারলেন শেষ পর্যন্ত দেশবাসীর ভরসা অক্ষুণ্ণ রাখতে?’’
শুধু আক্রমণ নয়, সায়নীর বক্তৃতায় ব্যঙ্গও ছিল বিজেপির বিরুদ্ধে। তাঁর কথায়, ‘‘কাহিনি ভাল বোনা হয়েছিল। কিন্তু সর্ষের তেলের বদলে কেরোসিন তেলে পকোড়া ভাজা হয়েছে!’’ অন্য বিরোধী সাংসদদের মতো সায়নীও প্রশ্ন তোলেন, কী ভাবে পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিরা ঢুকে পড়ল? কেন সেখানে পুলিশ পৌঁছোতে পারল না? পহেলগাঁও কাণ্ডের পর পরই জম্মু ও কাশ্মীরের লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিন্হা ‘নিরাপত্তার ব্যর্থতা’র কথা বলেছিলেন তিনি।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ব্যর্থতার প্রশ্ন
সায়নী আক্রমণ শানান গোয়েন্দা ব্যবস্থার দিকেও— “কেন গোয়েন্দাপ্রধানের কাছে জবাবদিহি চাওয়া হয়নি? কেন তাঁকে সরানোর বদলে মেয়াদ বৃদ্ধি করা হল?”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ (Amit Shah) জানান, হামলায় জড়িত তিন জঙ্গিকে নিকেশ করা হয়েছে। সেই প্রসঙ্গে সায়নীর ব্যঙ্গ, ‘‘আমরা ভাগ্যিস এখন আলোচনা শুরু করলাম, তাই জঙ্গিরা ধরা পড়ল। দু’মাস আগে করলে, আরও আগে ধরা পড়ত।’’
পাকিস্তানকে শক্ত বার্তার দাবি
তিনি বলেন, ভারত ইটের জবাব ইটে দিয়েছে, কিন্তু দেশবাসী চেয়েছিল ইটের জবাব পাথর দিয়ে দেওয়া হোক। তাঁর কথায়, “পাকিস্তানের পতাকায় চাঁদ আছে, আমাদের পতাকা রয়েছে চাঁদে— এ বার্তাই দেওয়া যেত।” বক্তৃতার শেষদিকে তিনি কবিতার ছলে যোগ করেন— “আমি ভয় করব না ভয় করব না, দু’বেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না।”
তথ্য, পরিসংখ্যান, কটাক্ষ ও আবেগ— সব মিলিয়ে ২০ মিনিটের বক্তৃতায় প্রথমবারের সাংসদ সায়নী ঘোষ প্রমাণ করলেন তাঁর রাজনৈতিক মঞ্চে নিজস্ব স্বকীয়তা। বিজেপিকে কঠোর আক্রমণ করলেও, সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানাতে ভোলেননি তিনি।