ভারতের কৃষি খাতে ডিজিটাল বিপ্লব এখন নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী মান্ডি ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে কৃষকরা এখন ডিজিটাল মান্ডি (Digital Mandi) প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তাঁদের ফসল বিক্রি করে উন্নত মূল্য ও দ্রুত পেমেন্ট পাচ্ছেন। ই-নাম (National Agriculture Market) এবং অন্যান্য অনলাইন মান্ডি প্ল্যাটফর্ম যেমন ফসলমান্ডি, নিনজাকার্ট এবং কিষাণমান্ডি কৃষকদের জন্য স্বচ্ছতা, ন্যায্য মূল্য এবং বাজারে সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করছে। তবে, এই প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রকৃত প্রভাব এবং কৃষকদের অভিজ্ঞতা কী বলছে? এই প্রতিবেদনে আমরা তা বিশ্লেষণ করব।
ই-নাম: কৃষকদের জন্য একটি নতুন দ্বার
ই-নাম হল ভারত সরকারের একটি উদ্যোগ, যা ২০১৬ সালের ১৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দ্বারা উদ্বোধন করা হয়েছিল। এই প্ল্যাটফর্মটি দেশের বিদ্যমান কৃষি উৎপাদন বাজার কমিটি (APMC) মান্ডিগুলোকে একটি কেন্দ্রীয় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত, ১৫২২টি মান্ডি ই-নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, এবং ১.৭৯ কোটি কৃষক এবং ২.৬৭ লক্ষ ব্যবসায়ী এই প্ল্যাটফর্মে নিবন্ধিত হয়েছেন। ই-নামের মাধ্যমে কৃষকরা তাঁদের ফসলের জন্য স্বচ্ছ নিলাম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন এবং অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে দ্রুত অর্থ পাচ্ছেন।
উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুরের কৃষক রামেশ্বর যাদব শেয়ার করেছেন, “ই-নামের মাধ্যমে আমি আমার ধান এবং গম বিক্রি করেছি। পূর্বে আমাদের স্থানীয় মান্ডিতে মধ্যস্থতাকারীদের উপর নির্ভর করতে হতো, যারা আমাদের ফসল কম দামে কিনে নিত। এখন আমি সরাসরি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি এবং ভালো দাম পাই। গত মরসুমে আমার আয় প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে।” তবে, তিনি আরও জানান, ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব এবং ইন্টারনেট সংযোগের সমস্যা কখনও কখনও তাঁদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।
অন্যান্য ডিজিটাল মান্ডি: ফসলমান্ডি ও নিনজাকার্ট
ই-নাম ছাড়াও বেসরকারি খাতে ফসলমান্ডি এবং নিনজাকার্টের মতো প্ল্যাটফর্ম কৃষকদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করছে। ফসলমান্ডি, যা ভারতের অন্যতম শীর্ষ অনলাইন কৃষি বাজার, কৃষকদের সরাসরি খুচরা বিক্রেতা এবং বড় ক্রেতাদের সঙ্গে সংযুক্ত করে। এই প্ল্যাটফর্মে কৃষকরা তাঁদের ফসলের তথ্য আপলোড করেন, যেমন—তরমুজ (৫০ ক্রেট, ২৫০ টাকা/ক্রেট) বা পেঁপে (১০০ ক্রেট, ৫০০ টাকা/ক্রেট), এবং ক্রেতারা সরাসরি তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এই স্বচ্ছ প্রক্রিয়া মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকা কমিয়ে কৃষকদের আয় বাড়িয়েছে।
নিনজাকার্ট, আরেকটি জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম, স্বচ্ছ মূল্য নির্ধারণ এবং নিরাপদ লেনদেনের জন্য পরিচিত। মহারাষ্ট্রের পুনের কৃষক শান্তারাম পাটিল বলেন, “নিনজাকার্টের মাধ্যমে আমি আমার সবজি সরাসরি বড় বড় রিটেলারদের কাছে বিক্রি করি। এতে আমার লাভ ১৫-২৫ শতাংশ বেড়েছে, এবং পেমেন্টও তাৎক্ষণিক পাই।” তবে, তিনি উল্লেখ করেন যে প্রাথমিকভাবে অ্যাপ ব্যবহারে সমস্যা হয়েছিল, কারণ তিনি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না।
কৃষকদের অভিজ্ঞতা ও আয় বৃদ্ধি
ই-নাম এবং অন্যান্য ডিজিটাল মান্ডি প্ল্যাটফর্ম কৃষকদের জন্য বেশ কিছু সুবিধা নিয়ে এসেছে। প্রথমত, এই প্ল্যাটফর্মগুলো মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকা কমিয়েছে, যারা প্রায়ই ফসলের মূল্যের একটি বড় অংশ নিয়ে নিত। দ্বিতীয়ত, রিয়েল-টাইম মূল্য তথ্য এবং স্বচ্ছ নিলাম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কৃষকরা তাঁদের ফসলের জন্য ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন। তৃতীয়ত, ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম পেমেন্টের বিলম্ব কমিয়েছে, যা ঐতিহ্যবাহী মান্ডিতে একটি বড় সমস্যা ছিল।
তামিলনাড়ুর তিরুচির কৃষক মুরুগান স্বামী বলেন, “ই-নামে আমি আমার হলুদ এবং তুলা বিক্রি করেছি। আগে স্থানীয় মান্ডিতে দাম নিয়ে দরকষাকষির কোনো সুযোগ ছিল না। এখন আমি দেশের বিভিন্ন মান্ডির দাম দেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। গত বছর আমার আয় প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে।” তবে, তিনি জানান যে গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগের সমস্যা এবং প্রযুক্তিগত শিক্ষার অভাব এখনও বড় বাধা।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ডিজিটাল মান্ডি প্ল্যাটফর্মগুলো কৃষকদের জন্য বড় সুযোগ নিয়ে এলেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অনেক কৃষক, বিশেষ করে প্রবীণ কৃষকরা, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে অভ্যস্ত নন। গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগের অভাব এবং স্মার্টফোনের সীমিত প্রবেশাধিকারও একটি বড় সমস্যা। এছাড়া, গুদামজাতকরণ এবং পরিবহনের লজিস্টিক সংক্রান্ত সমস্যা এখনও সমাধানের অপেক্ষায়।
ই-নাম এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম এই সমস্যাগুলো মোকাবিলায় কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ, ই-নাম মোবাইল অ্যাপে ভাষার বৈচিত্র্য (ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা, তামিল, তেলুগু ইত্যাদি) এবং এসএমএস-ভিত্তিক তথ্য পরিষেবা চালু করেছে, যাতে সাধারণ ফোন ব্যবহারকারী কৃষকরাও তথ্য পেতে পারেন। এছাড়া, কিষাণমান্ডি-এর মতো প্ল্যাটফর্ম গ্রাম সহায়কদের মাধ্যমে কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং লজিস্টিক সহায়তা দিচ্ছে।
সরকারও প্রধানমন্ত্রী মৎস্য সম্পদ যোজনা (PMMSY) এবং নীল বিপ্লবের মতো উদ্যোগের মাধ্যমে কৃষকদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছে। তবে, কৃষকদের মধ্যে ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়ানো এবং গ্রামীণ অঞ্চলে ইন্টারনেট পরিকাঠামো উন্নত করা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ই-নাম এবং অন্যান্য ডিজিটাল মান্ডি প্ল্যাটফর্ম ভারতের কৃষি বাজারে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। কৃষকদের রিয়েল-টাইম মূল্য তথ্য, স্বচ্ছ নিলাম এবং দ্রুত পেমেন্টের মাধ্যমে তাঁদের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, ডিজিটাল সাক্ষরতা এবং অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জগুলো সমাধান করা না গেলে এই প্ল্যাটফর্মগুলোর পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব হবে না। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা, যাঁরা ঐতিহ্যগতভাবে মাছ এবং ফসল উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছেন, তাঁরাও এই ডিজিটাল বিপ্লবে যোগ দিচ্ছেন। সঠিক প্রশিক্ষণ এবং সরকারি সহায়তার মাধ্যমে, এই প্ল্যাটফর্মগুলো ভারতীয় কৃষকদের জন্য একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়তে পারে।