‘সঙ্কটমোচন’ করতে পুজোপাঠে দিলীপ, খড়গপুরে ‘সুন্দর কাণ্ড’ পাঠের আয়োজন

শান্তনু পান, মেদিনীপুর, ২৮ জুলাই ২০২৫: একদা পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির ‘বাটল ম্যান’ হিসেবে পরিচিত দিলীপ ঘোষের (Dilip Ghosh) জন্য বর্তমান সময়টা মোটেই সুখকর নয়। গত কয়েক…

Dilip Ghosh Turns to Hanuman Puja to Overcome Crisis Amid Political and Social Turmoil in 2025

শান্তনু পান, মেদিনীপুর, ২৮ জুলাই ২০২৫: একদা পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির ‘বাটল ম্যান’ হিসেবে পরিচিত দিলীপ ঘোষের (Dilip Ghosh) জন্য বর্তমান সময়টা মোটেই সুখকর নয়। গত কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে একের পর এক ধাক্কা খাচ্ছেন তিনি। দলের অন্দরে তিনি যেন ‘কোণঠাসা’ হয়ে পড়েছেন, এমনটাই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। সম্প্রতি একটি ভিডিয়ো নিয়ে বিতর্ক তাঁর সমস্যাকে আরও গভীর করেছে। এই সঙ্কটের মুহূর্তে ‘সঙ্কটমোচন’ হনুমানজির শরণাপন্ন হয়েছেন প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ। খড়গপুরে তাঁর নিজের বাংলোতে শুরু হয়েছে ‘সুন্দর কাণ্ড’ পাঠের আয়োজন। আগামী ২১ দিন ধরে এই পুজোপাঠ চলবে, এবং জন্মাষ্টমীর দিনে নন্দ উৎসবের আয়োজন করা হবে। দিলীপ ঘোষ নিজেই বলেছেন, “শত্রু দমন এবং বিপদ নাশের জন্য এই আয়োজন করা হয়েছে। গত দু-তিন মাস ধরে আমার বিরুদ্ধে ব্যাপক চক্রান্ত চলছে। আমাকে বদনাম করার, কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা হচ্ছে।”

দিলীপ ঘোষের সঙ্কট: কী ঘটছে?
দিলীপ ঘোষ, যিনি একসময় পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির রাজ্য সভাপতি হিসেবে দলকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এখন ছায়া পড়েছে। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে তাঁকে মেদিনীপুরের পরিবর্তে বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে প্রার্থী করা হয়, যেখানে তিনি পরাজিত হন। এরপর থেকে দলের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়তে থাকে। শমীক ভট্টাচার্য রাজ্য সভাপতি হওয়ার পরেও দিলীপ ঘোষকে গুরুত্বপূর্ণ দলীয় কর্মসূচিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দুর্গাপুর সফর বা অমিত শাহের কলকাতা কর্মসূচিতেও তাঁকে দেখা যায়নি।

   

দিলীপ ঘোষের রাজনৈতিক সঙ্কটের পাশাপাশি সামাজিক জীবনেও অশান্তি দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছে, যেখানে তিনি ও একজন মহিলার উপস্থিতি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। দিলীপ ঘোষ এই ভিডিয়োর সত্যতা অস্বীকার করে কলকাতা পুলিশের সাইবার সেলে অভিযোগ দায়ের করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, এটি তাঁকে বদনাম করার জন্য একটি বড় ষড়যন্ত্রের অংশ। তিনি বলেছেন, “গত কয়েক মাস ধরে আমার বিরুদ্ধে নানাভাবে চক্রান্ত করা হচ্ছে। এই ভিডিয়ো আমার ইমেজ নষ্ট করার একটি প্রচেষ্টা।”

‘সুন্দর কাণ্ড’ পাঠ: সঙ্কটমোচনের পথ
এই সঙ্কটের মুহূর্তে দিলীপ ঘোষ আধ্যাত্মিক পথে আশ্রয় নিয়েছেন। খড়গপুরে তাঁর বাংলোতে ‘সুন্দর কাণ্ড’ পাঠের আয়োজন শুরু হয়েছে, যা রামচরিতমানসের একটি অংশ এবং হনুমানজির গুণগানে পূর্ণ। এই পাঠ ২১ দিন ধরে চলবে, এবং জন্মাষ্টমীর দিনে নন্দ উৎসবের মাধ্যমে এটি সমাপ্ত হবে। দিলীপ ঘোষ বলেছেন, “হনুমানজি সঙ্কটমোচন। তিনি শত্রু দমন করেন, বিপদ থেকে রক্ষা করেন। আমার জীবনে যে সঙ্কট এসেছে, তা কাটাতে এই পুজোপাঠের আয়োজন করেছি।” এই আয়োজনে স্থানীয় বিজেপি কর্মী ও সমর্থকদের পাশাপাশি ধর্মপ্রাণ মানুষজনও অংশ নিচ্ছেন।

‘সুন্দর কাণ্ড’ পাঠের আয়োজন শুধু ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিকভাবেও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। দিলীপ ঘোষের এই পদক্ষেপ তাঁর সমর্থকদের মধ্যে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা যে তিনি এখনও হার মানেননি এবং সঙ্কটের মধ্যেও লড়াই চালিয়ে যাবেন। একই সঙ্গে, ধর্মীয় আয়োজনের মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছেন।

রাজনৈতিক মহলের প্রতিক্রিয়া
দিলীপ ঘোষের এই পুজোপাঠের আয়োজন রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বিজেপির একাংশ মনে করছে, এটি তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাসের প্রকাশ, যা তাঁর সমর্থকদের মনোবল বাড়াতে পারে। তবে, দলের অন্য একটি অংশ মনে করছে, এই ধরনের আয়োজন দিলীপ ঘোষের রাজনৈতিক দুর্বলতাকেই তুলে ধরছে। একজন বিজেপি নেতা নাম প্রকাশ না করে বলেন, “দিলীপদা দলের মধ্যে তাঁর অবস্থান ফিরে পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন। কিন্তু এই ধরনের ধর্মীয় আয়োজন কতটা কাজে আসবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।”

Advertisements

অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা দিলীপ ঘোষের এই পদক্ষেপ নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ এক্স-এ একটি পোস্টে বলেছেন, “দিলীপ ঘোষের সময় ফুরিয়ে গেছে। পুজোপাঠ করে তিনি জনগণের সমর্থন ফিরিয়ে আনতে পারবেন না।” তবে, দিলীপ ঘোষ এই সমালোচনার জবাবে বলেছেন, “আমি আমার বিশ্বাসে অটল। যারা আমাকে বদনাম করছে, তাদের জবাব আমি কাজের মাধ্যমে দেব।”

ভিডিয়ো বিতর্ক: কী বলছে সোশ্যাল মিডিয়া?
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ভিডিয়োটি দিলীপ ঘোষের জন্য বড় বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এক্স-এ একাধিক পোস্টে দাবি করা হয়েছে যে এই ভিডিয়ো তাঁকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানোর জন্য ছড়ানো হয়েছে। দিলীপ ঘোষ নিজে কলকাতা পুলিশের লালবাজারে গিয়ে এই বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন। তিনি বলেছেন, “এই ভিডিয়ো সম্পূর্ণ ভুয়ো। আমার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র চলছে। আমি আইনি পথে এর বিরুদ্ধে লড়ব।”

সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ভিডিয়ো নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ দিলীপ ঘোষের পাশে দাঁড়িয়ে এটিকে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলছেন, আবার কেউ কেউ তাঁর বিরুদ্ধে কটাক্ষ করছেন। এক্স-এ একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “দিলীপ ঘোষ বিজেপির অন্দরে এবং বাইরে শত্রু তৈরি করেছেন। এই ভিডিয়ো তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য বড় ধাক্কা।”

দিলীপ ঘোষের জন্য ২০২৫ সাল রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনে সঙ্কটের বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। দলের অন্দরে তাঁর গুরুত্ব কমে যাওয়া, ভিডিয়ো বিতর্ক এবং সামাজিক সমালোচনার মধ্যে তিনি এখন হনুমানজির শরণ নিয়েছেন। খড়গপুরে ‘সুন্দর কাণ্ড’ পাঠের আয়োজন তাঁর আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের প্রকাশ হলেও, এটি রাজনৈতিকভাবেও তাঁর অস্তিত্ব জানান দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা। আগামী দিনে দিলীপ ঘোষ কীভাবে এই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠেন এবং বিজেপির রাজনীতিতে তাঁর অবস্থান কী হয়, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহল।