নয়াদিল্লি: ‘অপারেশন সিঁদুর’ ঘিরে সোমবার থেকে শুরু হচ্ছে সংসদে ৩২ ঘণ্টার বিশেষ আলোচনাপর্ব (Operation Sindoor Parliamentary Debate)। এই আলোচনাই হয়ে উঠতে চলেছে এবারের বাদল অধিবেশনের সবচেয়ে বিস্ফোরক অধ্যায়, যেখানে সরকার ও বিরোধীপক্ষ মুখোমুখি হতে চলেছে জাতীয় নিরাপত্তা, কূটনীতি ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা ঘিরে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং লোকসভায় এই বিতর্কের সূচনা করবেন। অপরদিকে, কংগ্রেসের পক্ষে আলোচনার সূচনা করবেন রাহুল গান্ধী, যা থেকেই স্পষ্ট, বিরোধীদের অবস্থান আক্রমণাত্মক।
রাজনৈতিক তরজা
অপারেশন সিঁদুরের সূত্রপাতকে কেন্দ্র করেই মূলত শুরু হয়েছে এই রাজনৈতিক তরজার। এটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কৌশলগত মস্তিষ্কপ্রসূত অভিযান বলে বিজেপি দাবি করে এসেছে। ফলে, বিরোধীদের জবাব দিতে সরকার চায় মোদীকেই সামনে আনতে। যদিও সরকারি ভাবে এখনও নিশ্চিত করা হয়নি, প্রধানমন্ত্রী আলোচনায় বক্তৃতা দেবেন কি না।
সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কিরেণ রিজিজু ইতিমধ্যেই বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রী কখন বলবেন, সেটা বিরোধীরা ঠিক করতে পারে না, যেমন আমরাও ঠিক করি না বিরোধীপক্ষের কে কথা বলবেন।” তবুও মোদীর বিদেশ সফর থেকে ফিরে আসার পরেই আলোচনা শুরু হওয়ায় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সরকার শেষ মুহূর্তে মোদীকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
ট্রাম্পের বিতর্কিত দাবি কেন্দ্রবিন্দুতে
এই বিতর্কে সবচেয়ে জ্বালাময় ইস্যু হয়ে উঠতে পারে আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্য। ট্রাম্প দাবি করেছেন, মে ১০ তারিখে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষ থামাতে তিনি বাণিজ্যিক চুক্তিকে ‘লালচ’ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ট্রাম্পের এমন দাবি ইতিমধ্যেই ২৫ বারের বেশি উঠে এসেছে তার বক্তব্যে।
ভারত সরকার স্পষ্ট জানিয়েছে, এমন কোনও মধ্যস্থতার প্রশ্নই ওঠে না। মোদী ও ট্রাম্পের মধ্যে গত মাসে হওয়া ৩৫ মিনিটের ফোনালাপে প্রধানমন্ত্রী নাকি সরাসরি ট্রাম্পকে সাফ জানিয়ে দেন, ভারতের কোনও ‘সিজফায়ার’ মার্কিন চাপে হয়নি। কিন্তু কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার্থে সরকার চাইছে না ট্রাম্পকে সরাসরি নিশানা করতে, কারণ ভারত-আমেরিকা বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত পর্বে রয়েছে।
বরং বিজেপি ঘরানার নেতা-মন্ত্রীরা কংগ্রেসকে আক্রমণ করতে পারেন ‘বিদেশি নেতার কথায় বিশ্বাস রেখে’ ‘জাতীয় স্বার্থে আঘাত’ করার অভিযোগে। প্রশ্ন তোলা হতে পারে, কেন কংগ্রেস ভারতের প্রধানমন্ত্রী নয়, বরং এক প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্টের মন্তব্যকে সত্য বলে ধরে নিচ্ছে?
কংগ্রেসের প্রত্যাঘাতের প্রস্তুতি
কংগ্রেসের পক্ষ থেকে মূল আক্রমণের জায়গা হবে, সেনা অভিযান নিয়ে স্বচ্ছতা, ট্রাম্পের মন্তব্যের সত্যতা, এবং প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘ নীরবতা। বিরোধীরা চাইছে, মোদী নিজে দাঁড়িয়ে সংসদে তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট করুন। সেই দাবি মানা হবে কি না, তা নিয়েই এখন প্রবল জল্পনা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০১৯ সালের বালাকোট এয়ারস্ট্রাইকের পর যে ধরনের রাজনৈতিক পাল্টা প্রচার বিজেপি করেছিল, এইবারেও সেই একই কৌশল ফের ব্যবহার করতে পারে। সরকার চাইবে, কংগ্রেসের ‘দেশপ্রেম’ নিয়ে প্রশ্ন তুলে গোটা বিতর্ককে রাজনৈতিক মেরুকরণের দিকে নিয়ে যেতে।
অপারেশন সিঁদুর: কৌশলগত ও রাজনৈতিক অস্ত্র
অপারেশন সিঁদুর এখন শুধু সীমান্তের একটি সামরিক কৌশল নয়, এটি বিজেপির দৃষ্টিভঙ্গিতে জাতীয়তাবাদের প্রতীক এবং মোদীর নেতৃত্বের প্রমাণ। ফলে সংসদে এই বিতর্কে সামরিক সাফল্যের বর্ণনার পাশাপাশি উঠে আসবে রাজনৈতিক বার্তাও, কে সত্যিকারের দেশভক্ত?
বিরোধী প্রশ্ন তুলবে দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে, আর সরকার পাল্টা তুলবে আস্থাহীনতা ও বিদেশ নির্ভরতার প্রশ্ন। আগামী ৩২ ঘণ্টার বিতর্ক তাই হয়ে উঠতে চলেছে মোদী বনাম রাহুল, সেনা বনাম সন্দেহ, এবং জাতীয়তাবাদ বনাম সংশয়বাদ, যার প্রতিটি শব্দে বাজবে ২০২9-এর লড়াইয়ের সুর।