কেন্দ্রীয় বঞ্চনা! জাতীয় সড়ক নেটওয়ার্কের সেরা দশে নেই বাংলা

ভারতের জাতীয় সড়ক নেটওয়ার্কের (National Highway Network) বিস্তারে অবশ্যই একটি বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটেছে, তবে এই উন্নয়নে পশ্চিমবঙ্গের অবদান এবং অবস্থান যথেষ্ট কমজোরী হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক…

West Bengal Misses Top 10 in National Highway Network, Sparks Central Neglect Debate

ভারতের জাতীয় সড়ক নেটওয়ার্কের (National Highway Network) বিস্তারে অবশ্যই একটি বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটেছে, তবে এই উন্নয়নে পশ্চিমবঙ্গের অবদান এবং অবস্থান যথেষ্ট কমজোরী হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ভারতের শীর্ষ ১০ রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় জাতীয় সড়ক নেটওয়ার্কের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের নাম নেই। এই তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে মহারাষ্ট্র (১৮,৪৬২ কিলোমিটার), দ্বিতীয় স্থানে উত্তরপ্রদেশ (১২,১২৩ কিলোমিটার), এবং তৃতীয় স্থানে রাজস্থান (১০,৭৩৩ কিলোমিটার), কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এই তালিকায় কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এই তথ্য প্রকাশের পর থেকে রাজ্যের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাবিদদের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, এবং এটি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি একটি বড় প্রশ্ন তোলার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গ, যে রাজ্যটির জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনা করলে এটির জন্য উন্নত সড়ক নেটওয়ার্ক অত্যন্ত জরুরি, সেই রাজ্যটি কেন এই তালিকায় পিছিয়ে পড়েছে? বিশেষজ্ঞদের মতে, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে যে মাধ্যমে জাতীয় সড়ক নির্মাণে ত্বরান্বিত করা হচ্ছে, তাতে পশ্চিমবঙ্গের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া হয়নি। জাতীয় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক মন্ত্রণালয় (MoRTH) থেকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলোতে বড় প্রকল্পগুলোর সংখ্যা এবং বিনিয়োগ বেশি, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এই সুযোগটি কম পড়েছে।

   

পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে জাতীয় সড়ক নেটওয়ার্কের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪,৫০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি বলে অনুমান করা হচ্ছে, যা ভারতের মোট জাতীয় সড়কের মাত্র ৩% এর কম। এই তথ্যের সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যায় যে, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যটি একা ভারতের জাতীয় সড়ক নেটওয়ার্কের প্রায় ১৫% নিয়ন্ত্রণ করে। এই পার্থক্যের কারণ হতে পারে রাজ্যের রাজনৈতিক সমীকরণ বা কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের অবস্থা। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার কেন্দ্রের ওপর অভিযোগ করেছে যে, তাদের রাজ্যের জন্য যথাযথ বাজেট বরাদ্দ না হওয়ার কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

রাজ্যের পরিবহনমন্ত্রী শ্রীযুক্ত ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গের জনগোষ্ঠী এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপের জন্য উন্নত সড়ক নেটওয়ার্ক অত্যন্ত জরুরি। তবুও কেন্দ্রীয় সরকার আমাদের প্রকল্পগুলোর জন্য যথেষ্ট তহবিল বরাদ্দ করছে না। আমরা নিজেদের স্তরে কাজ করছি, যেমন পশ্চিমবঙ্গ হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (WBHDCL) এর মাধ্যমে কিছু চার-লেন সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে, কিন্তু এটি পর্যাপ্ত নয়।” তিনি আরও জানিয়েছেন যে, রাজ্য সরকার কেন্দ্রের কাছে বারবার আবেদন করেছে যাতে জাতীয় সড়ক নেটওয়ার্কে বাংলার অংশ বাড়ানো হয়, তবে এখনও পর্যন্ত সফলতা পাওয়া যায়নি।

এর পাশাপাশি, রাজ্যের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ও এই অবহেলার প্রভাব বোধ করছে। কলকাতা চেম্বার অফ কমার্সের একজন সদস্য বলেন, “উন্নত সড়ক নেটওয়ার্কের অভাবে আমাদের পণ্য পরিবহনে সময় এবং খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এটি আমাদের অর্থনৈতিক প্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করছে।” উদাহরণস্বরূপ, নতুন জাতীয় সড়ক প্রকল্পগুলোর মতো কাজগুলো যদি ত্বরান্বিত না হয়, তাহলে পশ্চিমবঙ্গের শিল্প ও বাণিজ্য খাতে নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ করা কঠিন হবে।

Advertisements

কিন্তু এই পরিস্থিতির জন্য কেবল কেন্দ্রকেই দায়ী করা যায় কি? বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজ্য সরকারও কিছু দায়িত্ব নিতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় সড়ক প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে ভূমি অধিগ্রহণ ও স্থানীয় প্রতিবাদের সমস্যা প্রায়ই দেখা দেয়, যা কাজের গতি কমিয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, কিছু এলাকায় চার-লেন সড়ক নির্মাণের কাজ বছরের পর বছর বিলম্বিত হচ্ছে, কারণ স্থানীয় গণতন্ত্রী আন্দোলন এবং প্রশাসনিক জটিলতা এড়ানো যাচ্ছে না।

এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে একটি সুষ্ঠু সহযোগিতার প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গের জন্য নতুন সড়ক প্রকল্পের পরিকল্পনা করতে হলে ভূমি অধিগ্রহণ নীতিতে সংশোধন এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সম্মতি নেওয়ার একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া গড়ে তোলা জরুরি। একইসঙ্গে, কেন্দ্রীয় সরকারকে বাংলার জন্য আরও বেশি তহবিল ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করতে হবে।

সামগ্রিকভাবে, পশ্চিমবঙ্গের জাতীয় সড়ক নেটওয়ার্কের পিছিয়ে পড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা রাজ্যের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। এই সমস্যার সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে, বাংলা ভারতের উন্নত রাজ্যগুলোর তালিকায় আরও পিছিয়ে পড়তে পারে। তাই, রাজ্যের নাগরিকরা এখন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কাছ থেকে একটি স্পষ্ট উত্তর এবং কার্যকরী পরিকল্পনা আশা করছে।