ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক শুভমান গিল (Shubman Gill) তার অসাধারণ ব্যাটিং ফর্ম অব্যাহত রেখে কিংবদন্তি ডন ব্র্যাডম্যানের একটি ৮৭ বছরের পুরনো রেকর্ড ভেঙে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজের চতুর্থ ম্যাচে ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে গিল তাঁর চতুর্থ সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে একটি দ্বিপাক্ষিক টেস্ট সিরিজে সফরকারী অধিনায়ক হিসেবে সর্বাধিক সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েছেন।
ব্র্যাডম্যান ১৯৩৮ সালের অ্যাশেজ সিরিজে চারটি সেঞ্চুরি করেছিলেন, এবং গিল এখন এই কীর্তিতে তাঁকে ছাড়িয়ে গিয়ে এককভাবে শীর্ষে অবস্থান করছেন। এই অসাধারণ অর্জন গিলের নেতৃত্ব এবং ব্যাটিং দক্ষতার প্রমাণ বহন করে, যিনি মাত্র ২৫ বছর বয়সে ভারতীয় ক্রিকেটে এক নতুন যুগের সূচনা করছেন।
ম্যানচেস্টারে গিলের বীরত্ব
চতুর্থ টেস্টের চতুর্থ দিনে ভারত যখন জয়সয়াল এবং সাই সুদর্শন এর উইকেট প্রথম ওভারেই হারিয়ে শূন্য রানে দুই উইকেট হারিয়ে চাপে পড়েছিল, তখন গিল তাঁর অধিনায়কোচিত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দলের হাল ধরেন এবং কেএল রাহুলের সঙ্গে মিলে একটি গুরুত্বপূর্ণ জুটি গড়ে তোলেন।
পঞ্চম দিনে তিনি তাঁর অপরাজিত ৭৮ রান থেকে শুরু করে একটি দুর্দান্ত সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন, যা তিনি পয়েন্টের দিকে একটি ক্রিস্প কাট শটের মাধ্যমে অর্জন করেন। এই ইনিংসে তিনি কোনো উৎসবমুখর উদযাপন করেননি, কেবল ড্রেসিংরুমের দিকে একটি দৃষ্টি এবং ব্যাটের একটি টোকা দিয়ে নিজের কাজ অব্যাহত রাখেন।
এই সেঞ্চুরি তাঁর সিরিজের চতুর্থ সেঞ্চুরি, যা তাঁকে ডন ব্র্যাডম্যান, সুনীল গাভাস্কার এবং বিরাট কোহলির মতো কিংবদন্তিদের সঙ্গে একই তালিকায় নিয়ে এসেছে। গিল এখন একমাত্র তৃতীয় ভারতীয় ব্যাটার হিসেবে একটি টেস্ট সিরিজে চারটি সেঞ্চুরি করেছেন, গাভাস্কার (১৯৭১, ১৯৭৮-৭৯) এবং কোহলি (২০১৪-১৫) এর পরে।
রেকর্ডের পর রেকর্ড
গিলের এই সিরিজে ইতিমধ্যেই ৫৮৫ রান রয়েছে, যা তিনি মাত্র চারটি ইনিংসে সংগ্রহ করেছেন, গড় ১৪৬.২৫। এডজবাস্টনে দ্বিতীয় টেস্টে তিনি ২৬৯ এবং ১৬১ রানের দুটি দুর্দান্ত ইনিংস খেলে ভারতকে জয়ের পথে নিয়ে যান। এই ম্যাচে তিনি মোট ৪৩০ রান করেন, যা টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে একটি ম্যাচে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড।
তিনি বিরাট কোহলির ২৫৪ রানের রেকর্ড ভেঙে ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ড গড়েছেন এবং সচিন তেন্ডুলকরের ২৪১* রানের রেকর্ড ভেঙে এশিয়ার বাইরে ভারতীয় ব্যাটার হিসেবে সর্বোচ্চ রানের মালিক হয়েছেন।
গিল এই সিরিজে আরও কয়েকটি রেকর্ডের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। তিনি ডন ব্র্যাডম্যানের ১৯৩৬-৩৭ অ্যাশেজে অধিনায়ক হিসেবে ৮১০ রানের রেকর্ড থেকে মাত্র ২২৫ রান দূরে। এছাড়া, তিনি সুনীল গাভাস্কারের ১৯৭৮-৭৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ৭৩২ রানের ভারতীয় অধিনায়কের রেকর্ড থেকে ১৪৮ রান দূরে। ব্র্যাডম্যানের ১৯৩০ সালের অ্যাশেজে ৯৭৪ রানের সর্বকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড ভাঙতে গিলের প্রয়োজন ৩৯০ রান, যা তিনটি টেস্ট বাকি থাকায় অসম্ভব নয়।
ইতিহাসে গিলের স্থান
গিলের এই অর্জন তাঁকে ক্রিকেট ইতিহাসের একটি বিশেষ স্থানে নিয়ে গেছে। তিনি টেস্ট ক্রিকেটের ১৪৮ বছরের ইতিহাসে প্রথম ব্যাটার হিসেবে একটি ম্যাচে একটি ডাবল সেঞ্চুরি এবং একটি ১৫০+ রানের ইনিংস খেলেছেন।
এডজবাস্টনে তাঁর ২৬৯ রানের ইনিংস ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে সর্বোচ্চ এবং বিদেশের মাটিতে তৃতীয় সর্বোচ্চ। তিনি সিএনএ (দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া) দেশগুলিতে প্রথম এশিয়ান অধিনায়ক হিসেবে ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন।
ম্যানচেস্টারে তাঁর সাম্প্রতিক সেঞ্চুরি তাঁর নেতৃত্বের গুণমান এবং চাপের মুখে পারফর্ম করার ক্ষমতা প্রদর্শন করে। তিনি যখন ব্যাট করতে নামেন, ভারত ০/২-এর ভয়াবহ অবস্থায় ছিল। তাঁর অধিনায়কত্বের সমালোচনা হচ্ছিল, বিশেষ করে তাঁর ফিল্ডিং স্থাপন এবং বোলিং পরিবর্তন নিয়ে।
কিন্তু গিল ব্যাট হাতে উত্তর দিয়েছেন, একটি স্থিতিশীল এবং দৃঢ় ইনিংস খেলে ভারতকে ম্যাচে রেখেছেন। তাঁর এই ইনিংসে নিয়ন্ত্রণ ছিল অসাধারণ, যেখানে তিনি মাত্র ৯৩.২৮% কন্ট্রোল পার্সেন্টেজ নিয়ে খেলেছেন, যা ইংল্যান্ডে সাম্প্রতিক সময়ে সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রিত ইনিংসগুলির মধ্যে একটি।
ভারতীয় ক্রিকেটে নতুন যুগ
২৫ বছর বয়সী গিল তাঁর প্রথম টেস্ট সিরিজে অধিনায়ক হিসেবে এমন অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটে এক নতুন যুগের সূচনা করেছেন। তিনি কেবল ব্র্যাডম্যানের রেকর্ডই ভাঙেননি, বরং বিরাট কোহলির ২০১৪-১৫ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরে ৬৯২ রানের রেকর্ড ভেঙে সিএনএ দেশগুলিতে একটি সিরিজে সর্বাধিক রানের ভারতীয় ব্যাটার হয়েছেন। তিনি ইতিমধ্যে ৬৯৭ রান সংগ্রহ করেছেন এবং এখনও দুটি ইনিংস বাকি রয়েছে।
গিলের এই পারফরম্যান্স ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তদের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি করেছে। সামাজিক মাধ্যমে ভক্তরা তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, অনেকে বলছেন, “গিল শুধু রেকর্ডই ভাঙছেন না, তিনি ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ গড়ছেন।” তাঁর এই ফর্ম অব্যাহত থাকলে, তিনি ক্লাইড ওয়ালকটের ১৯৫৫ সালে পাঁচটি সেঞ্চুরির রেকর্ডের সঙ্গে সমান হতে পারেন, যা এখনও একটি সিরিজে সর্বাধিক সেঞ্চুরির রেকর্ড।
শুভমান গিলের এই অসাধারণ পারফরম্যান্স তাঁকে ক্রিকেটের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান দিয়েছে। তিনি কেবল ডন ব্র্যাডম্যানের মতো কিংবদন্তির রেকর্ড ভেঙেছেন, বরং তাঁর নেতৃত্ব এবং ব্যাটিং দক্ষতার মাধ্যমে ভারতীয় ক্রিকেটের এক নতুন অধ্যায় লিখছেন।
আগ্রায় ধর্মান্তরের আড়ালে মহিলা স্লিপার সেল! অভিযুক্ত দুই পাকিস্তানি নাগরিক
সিরিজের বাকি ম্যাচগুলিতে তিনি আরও কী কী রেকর্ড ভাঙবেন, তা দেখার জন্য ক্রিকেট বিশ্ব অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। গিলের এই যাত্রা কেবল তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, বরং ভারতীয় ক্রিকেটের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতীক।