নয়াদিল্লি: দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং কূটনৈতিক টানাপড়েনের প্রেক্ষাপটে ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্ক যেন এক নতুন দিশা পেল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রতিক মালদ্বীপ সফরে (India Maldives Relations)। মালেতে প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জুর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসে মোদী দৃঢ়ভাবে স্মরণ করালেন দুই দেশের ঐতিহাসিক সম্পর্কের শিকড়, যা তাঁর কথায় “ইতিহাসেরও আগে, আর সমুদ্রের মতোই গভীর”। এই সফরের মাধ্যমে দুই দেশ কেবল বন্ধুত্ব পুনর্নির্মাণ করল না, বরং প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যৌথ অংশীদারিত্বকে এক নতুন মাত্রা দিল।
ভারতবিরোধী অবস্থান নিয়েছিল মুইজ্জুর
সম্প্রতি “India Out” আন্দোলনের আবহে ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্ক কিছুটা সংকটের মুখে পড়েছিল। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট পদে বসার পর মুইজ্জুর ভারতবিরোধী অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত মানচিত্রে এক উদ্বেগজনক প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছিল। সেই প্রেক্ষাপটেই মোদীর সফর ছিল কূটনৈতিকভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এবং বাস্তবে, এই সফরেই সেই অবিশ্বাস ও অনীহার পর্দা সরে গিয়ে, দুই দেশের বন্ধুত্ব নতুন আস্থা ও দৃঢ়তার পথে ফিরে এল। মোদী স্পষ্ট বার্তা দেন, “পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, ভারত-মালদ্বীপের বন্ধুত্ব চিরকালই উজ্জ্বল ও অটুট থাকবে।” পাল্টা বক্তব্যে মুইজ্জুও ভারতকে তাঁর দেশের “সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য উন্নয়নসঙ্গী” বলে অভিহিত করেন।
এই আস্থা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে ভারত মালদ্বীপের জন্য ৪,৮৫০ কোটি টাকার ঋণ সহায়তা ঘোষণা করেছে, যা দেশের পরিকাঠামোগত অগ্রাধিকার অনুযায়ী ব্যয় করা হবে। ভারতের বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রীর কথায়, এই ঋণচুক্তির ফলে মালদ্বীপের বার্ষিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ প্রায় ৪০ শতাংশ কমে আসবে। শুধু আর্থিক সাহায্যেই নয়, প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও দুই দেশের বন্ধন আরও দৃঢ় হয়েছে। মালেতে নির্মিত ভারত-সহায়িত নতুন প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দফতর উদ্বোধন করেন মোদী ও মুইজ্জু, যেখানে মোদী এই স্থাপনাকে “বিশ্বাসের কংক্রিট প্রতীক” বলে ব্যাখ্যা করেন।
মলদ্বীপকে যানবাহন ও আধুনিক সরঞ্জাম
সফরকালে একসঙ্গে উদ্বোধন করা হয়েছে একাধিক ভারত-সহায়িত প্রকল্প, মালেতে প্রতিরক্ষা দফতরের পাশাপাশি আদ্দু শহরে রাস্তা ও নিকাশি প্রকল্প, হুলহুমালেতে ৩,৩০০ আবাসন ইউনিট। ভারতের তরফে মালদ্বীপ ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সকে ৭২টি যানবাহন ও আধুনিক সরঞ্জামও হস্তান্তর করা হয়। এসব প্রকল্প কেবল প্রতীকী নয়, বরং দুই দেশের জনগণের দৈনন্দিন জীবনে ভারতের সক্রিয় উপস্থিতির বাস্তব নিদর্শন।
প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু প্রধানমন্ত্রী মোদীকে অভিনন্দন জানান তাঁর টানা ৪,০৭৮ দিন প্রধানমন্ত্রিত্বে থাকার ঐতিহাসিক কৃতিত্বের জন্য, যা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর রেকর্ডকে ছাপিয়ে গিয়েছে। তাঁর মতে, “এই অসাধারণ অধ্যায় মোদীর দেশসেবা ও জনকল্যাণে অঙ্গীকারের স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি, এবং ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্কেও তা একটি স্থায়িত্বের বার্তা দেয়।”
দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তি চূড়ান্ত
আগামী দিনে ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তি চূড়ান্ত হবে বলে ঘোষণা করেন মোদী, পাশাপাশি জানানো হয়েছে যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। যদিও সফরে সরাসরি চীনের প্রসঙ্গ তোলা হয়নি, তবে স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে যে ভারত মালদ্বীপের সঙ্গে যৌথভাবে এমন কোনও পদক্ষেপে অংশ নিচ্ছে, যা শুধু ভারতের নয়, এই গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তা ও কৌশলগত ভারসাম্যের সঙ্গেও গভীরভাবে সম্পর্কিত।
এই সফরের প্রতিটি মুহূর্তই ছিল দ্বিপাক্ষিক আস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সম্পর্কের পুনর্গঠনের এক সুস্পষ্ট বার্তা। মোদী-মুইজ্জুর হাত ধরে ভারত ও মালদ্বীপের বন্ধুত্বের গল্প ফিরে এল তার চিরকালীন গভীরতা ও গম্ভীরতায়, যেমনটা সমুদ্র, যেখান থেকে এই সম্পর্কের রূপক সৃষ্টি।