ইংল্যান্ডের ব্যাটিং মেসিয়ো জো রুট (Joe Root) ওল্ড ট্রাফোর্ডে ভারতের বিরুদ্ধে চতুর্থ টেস্টের তৃতীয় দিনে ১৫০ রানের একটি অসাধারণ ইনিংস খেলে টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে নিজের নাম আরও গভীরভাবে খোদাই করেছেন। এই ইনিংসের মাধ্যমে তিনি টেস্ট ক্রিকেটে সর্বকালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়েছেন, রাহুল দ্রাবিড় (১২,২৮৮ রান), জ্যাক কালিস (১৩২৮৯ রান), এবং রিকি পন্টিং (১৩৩৭৮ রান) কে ছাড়িয়ে গেছেন। এই কৃতিত্ব অর্জনের পর প্রাক্তন ইংল্যান্ড ক্রিকেটার জনাথন ট্রট জো রুটের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বলেছেন, “প্রতিটি ইনিংসে তিনি নিজের দক্ষতাকে আরও নিখুঁত করছেন।” এই ইনিংসে রুট তাঁর ৩৮তম টেস্ট সেঞ্চুরি করেছেন, যা তাঁকে কুমার সাঙ্গাক্কারার সমান স্থানে নিয়ে গেছে। এখন শুধু পন্টিং (৪১), কালিস (৪৫), এবং সচিন তেন্ডুলকর (৫১) তাঁর উপরে রয়েছেন।
রুটের ইনিংস: ধৈর্য ও ক্লাসের মিশেল
ইংল্যান্ড যখন ১৯৭/২-এ ব্যাটিং শুরু করে, তখন জো রুট এসে ইনিংসের নোঙ্গর হয়ে দাঁড়ান। দুই দিন ধরে চলা তাঁর এই সাবলীল ইনিংস ধৈর্য, কৌশল এবং ক্লাসের এক অপূর্ব সমন্বয় ছিল। ভারতীয় বোলারদের বিরুদ্ধে তিনি নিখুঁতভাবে ড্রাইভ এবং নাজ করেছেন। জনাথন ট্রট জিওহটস্টারে বলেছেন, “জো রুটের পদ্ধতি এতটাই শক্তিশালী যে তিনি খুব কমই নাটকীয়ভাবে গিয়ার বদলান। বাজবল যখন প্রথম এসেছিল, তিনি র্যাম্প শট, রিভার্স স্কুপের মতো পরীক্ষা করেছিলেন। কিন্তু এখন তিনি সেগুলো ছেড়ে দিয়ে নিজের শক্তির জায়গায় ফিরে এসেছেন। তিনি এমন একটি ভারসাম্য খুঁজে পেয়েছেন, যা তাঁকে অপরাজেয় করে তুলেছে।”
ট্রট আরও বলেন, “যখন বিরোধী দল, যেমন আজ ভারত, যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে না, তখন রুট গার্ড নিয়ে দাঁড়ান এবং মানসিকভাবে সারাদিন ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁকে আউট করতে হলে বোলারদের অসাধারণ বল করতে হয়, আর আজ ভারত তা পারেনি। ফল? আরেকটি ১৫০ রানের ইনিংস।” রুটের এই ইনিংস ইংল্যান্ডকে ৫৪৪/৭-এ নিয়ে যায়, যা ভারতের প্রথম ইনিংসের তুলনায় ১৮৬ রানের লিড।
রুটের রেকর্ড-ভাঙা যাত্রা
২০১২ সালে নাগপুরে ভারতের বিরুদ্ধে টেস্ট অভিষেকের পর থেকে জো রুট ইংল্যান্ডের ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড হয়ে উঠেছেন। তিনি বর্তমানে টেস্ট ক্রিকেটে ১৩,৪০৯ রান নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন, শুধুমাত্র সচিন তেন্ডুলকরের (১৫,৯২১ রান) পিছনে। তিনি ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক এবং সর্বাধিক সেঞ্চুরির (৩৮টি) রেকর্ডধারী। এই ইনিংসে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে ৩,০০০ রানের মাইলফলকও স্পর্শ করেছেন, যা তাঁকে গ্যারি সোবার্স এবং সচিন তেন্ডুলকরের পাশে দাঁড় করিয়েছে।
ভারতের চ্যালেঞ্জ: মাঞ্জরেকারের বিশ্লেষণ
প্রাক্তন ভারতীয় ব্যাটার সঞ্জয় মাঞ্জরেকার মনে করেন, ১৮৬ রানে পিছিয়ে থাকলেও ভারত ড্রয়ের কথা ভাবছে না। তিনি বলেন, “ভারত ড্রয়ের কথা ভাববে না। তারা চাইবে রোদ উঠুক, যাতে তারা রান তাড়া করতে পারে এবং ইংল্যান্ডের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। পিচে অসমান বাউন্স দেখা যাচ্ছে, যা কিছু বোলারের জন্য কঠিন হতে পারে। ক্রিস ওকস হয়তো ততটা কার্যকর হবেন না, তবে বেন স্টোকসকে অনেক ওভার বোলিং করতে হবে। জোফ্রা আর্চারের লম্বা অ্যাকশন এবং স্টাম্পে আঘাত করার ক্ষমতা বিপজ্জনক হতে পারে, বিশেষত যদি বল নিচু হয়। আর লিয়াম ডসনের দিকে নজর রাখুন। তিনি হয়তো অবিশ্বাস্য বল করেন না, তবে তিনি ইংল্যান্ডের বোলিং কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।”
রুটের বাজবল থেকে ক্লাসিক্যাল রূপান্তর
ইংল্যান্ডের ‘বাজবল’ দর্শনের প্রথম দিনগুলোতে রুটো রিভার্স র্যাম্প এবং আক্রমণাত্মক শট খেলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তিনি তাঁর শক্তিশালী কৌশলে ফিরে এসেছেন। ট্রটের মতে, রুট এখন এমন একটি ভারসাম্য খুঁজে পেয়েছেন যা তাঁকে যেকোনো পরিস্থিতিতে আধিপত্য বিস্তার করতে দেয়। তাঁর এই ইনিংসে মাত্র ৯টি চার ছিল, যা পিচের কঠিন অবস্থা এবং ভারতীয় বোলারদের ধারাবাহিকতার ইঙ্গিত দেয়। তবুও, রুটের ধৈর্য এবং মানসিক দৃঢ়তা তাঁকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিল।
ইংল্যান্ডের শক্ত অবস্থান
রুটের ১৫০ রানের ইনিংসে ইংল্যান্ড চতুর্থ দিনে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। বেন স্টোকস এবং লিয়াম ডসন এখনও ক্রিজে আছেন, এবংল্যান্ড আরও লিড বাড়ানোর চেষ্টা করবে। ভারতের জন্য দ্রুত উইকেট তুলে নেওয়া এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু রুটের মাস্টারক্লাস তাদের পিছিয়ে দিয়েছে। রাভিন্দ্র জাদেজা রুটকে স্টাম্পিংয়ের মাধ্যমে আউট করলেও ইংল্যান্ডের লিড ইতিমধ্যেই যথেষ্ট বড়ে গেছে।
রুটের ভবিষ্যৎ: সচিনের রেকর্ডে চোখ
৩৪ বছর বয়সে রুট এখনও তাঁর শীর্ষ ফর্মে রয়েছেন। রিকি পন্টিংয়ের মতো কিংবদন্তিরা বিশ্বাস করেন, তিনি সচিন তেন্ডুলকরের ১৫,৯২১ রানের রেকর্ড ভাঙতে পারেন। রুট নিজে বলেছেন, “আমি শুধু খেলা উপভোগ করতে চাই। কোনো রেকর্ড ভাঙার কথা ভাবি না।” তবে তাঁর বর্তমান ফর্ম এবং ধারাবাহিকতা দেখে মনে হয়, তিনি তেন্ডুলকরের রেকর্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
জো রুটের ১৫০ রানের ইনিংস শুধু ইংল্যান্ডের জন্যই নয়, ক্রিকেট ইতিহাসের জন্যও একটি মাইলফলক। তাঁর ধৈর্য, কৌশল এবং মানসিক শক্তি তাঁকে আধুনিক ক্রিকেটের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাটারে পরিণত করেছে। ভারতের জন্য এখন চ্যালেঞ্জ হল দ্রুত উইকেট তুলে ম্যাচে ফিরে আসা, কিন্তু রুটের মাস্টারক্লাস তাদের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রিকেট বিশ্ব এখন অপেক্ষা করছে রুটের পরবর্তী মাইলফলকের জন্য, যা হয়তো সচিনের রেকর্ডকেই স্পর্শ করবে।