এই মুহূর্তে রাজ্য রাজনীতির অন্যতম আলোচিত নাম—হুমায়ুন কবীর (Humayun Kabir)। মুর্শিদাবাদের ভরতপুরের বর্তমান তৃণমূল বিধায়ক। সদ্য ঘোষণা করেছেন নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কথা। এই ঘোষণার পর থেকেই রাজনৈতিক মহলে আলোচনার ঝড়। অতীতে কংগ্রেস, তৃণমূল ও বিজেপি—সব দলে নাম লেখানো হুমায়ুনকে ‘দলবদলু’ তকমা দেওয়া হয়েছে বহুবার। অথচ এক সময় তাঁর রাজনৈতিক উত্থান ছিল চূড়ান্ত গতিশীল। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একসময় তাঁকে রাজ্যের মন্ত্রিত্ব পর্যন্ত দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।
কংগ্রেস থেকেই শুরু, তারপর মমতার মন্ত্রিসভায়
১৯৮২ সালে কংগ্রেসের হাত ধরে রাজনীতির যাত্রা শুরু করেন হুমায়ুন কবীর। তখন অধীররঞ্জন চৌধুরী ছিলেন আরএসপিতে। ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধীর আমলে অধীর কংগ্রেসে যোগ দেন। হুমায়ুনও তাঁর ছায়াতেই ক্রমে মুর্শিদাবাদ জেলা রাজনীতির পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। ১৯৯৯ সালে অধীর বহরমপুরের সাংসদ নির্বাচিত হলে হুমায়ুন তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসাবে সামনে আসেন।
২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের টিকিটে রেজিনগর কেন্দ্র থেকে জয়ী হন হুমায়ুন কবীর। প্রথমবারেই বিধানসভায় প্রবেশ করেন। এরপরের বছরই ঘটে নাটকীয় মোড়। কংগ্রেস-তৃণমূল জোট ভেঙে যায়। কংগ্রেসের পাঁচ মন্ত্রী পদত্যাগ করলে, তৃণমূল সেই শূন্যস্থান পূরণে হুমায়ুন কবীর ও কৃষ্ণেন্দু নারায়ণ চৌধুরীর মতো কংগ্রেস বিধায়কদের মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দেয়। তৃণমূলে যোগ দিয়ে হুমায়ুন রাজ্যের প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের প্রতিমন্ত্রী হন।
শপথ নিলেও মন্ত্রিত্ব রক্ষা করতে ব্যর্থ
কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী, মন্ত্রী হয়ে থাকতে হলে ছয় মাসের মধ্যে তাঁকে তৃণমূলের টিকিটে উপনির্বাচনে জিততে হত। ইংরেজবাজারে কৃষ্ণেন্দু জিতলেও রেজিনগরে হেরে যান হুমায়ুন। ফলে তাঁকে মন্ত্রিত্ব খোয়াতে হয়। বিধায়ক পদ তো আগেই ছেড়েছিলেন। মন্ত্রিত্ব হাতছাড়া হওয়ার পর তৃণমূলের একাংশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন। তাঁর দাবি, দলের ভিতরের গোষ্ঠীকোন্দলের কারণেই তিনি হেরেছেন। দলবিরোধী মন্তব্যের জেরে তাঁকে সাসপেন্ড করে তৃণমূল।
২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে নির্দল প্রার্থী হয়ে রেজিনগরে লড়লেও জিততে পারেননি। তৃণমূল প্রার্থী তৃতীয় স্থানে চলে যান। এরপর হুমায়ুন ফেরেন কংগ্রেসে। ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটে কংগ্রেসের প্রার্থী হন। কিন্তু সে বছরই গেরুয়া শিবিরে পা রাখেন। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থী হন মুর্শিদাবাদ থেকে, যদিও পরাজিত হন।
আবারও ঘাসফুলে ফেরা ও নতুন বার্তা
২০২১ সালের ভোটের আগে হুমায়ুন ফের তৃণমূলে যোগ দেন। ভরতপুর কেন্দ্র থেকে জিতে ফের বিধায়ক হন। কিন্তু দলে কখনই তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল না বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। গুরুত্বপূর্ণ কোনও সাংগঠনিক দায়িত্ব বা মন্ত্রিত্ব আর জোটেনি। মাঝেমধ্যেই দল ও নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন তিনি। দল তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও প্রকাশ্যে ‘বিদ্রোহী সুর’ বজায় রেখেছেন।
এবার ছাব্বিশের ভোটের মুখে নিজের রাজনৈতিক দল গড়ার কথা ঘোষণা করে ফের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে হুমায়ুন কবীর। তাঁর এই পদক্ষেপে শুধু তৃণমূল নয়, কংগ্রেস ও বিজেপির স্থানীয় সমীকরণেও প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একসময় যে ভরসা করে তাঁকে মন্ত্রী করেছিলেন, সেই আসন টিকিয়ে রাখতে পারেননি হুমায়ুন কবীর। বরং রাজনীতিতে একের পর এক দলবদলের নজির গড়েছেন। এবার দেখার, তাঁর নতুন রাজনৈতিক কৌশল তাঁকে কোথায় নিয়ে যায়।
🔎 কী বলছে রাজনৈতিক মহল?
রাজনীতিতে একাধিক দলবদলের নজির বিরল নয়। কিন্তু একাধিকবার সুযোগ পেয়েও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারার ব্যর্থতা হুমায়ুনের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। তবে নতুন দল গঠনের ঘোষণা রাজ্যে রাজনৈতিক উত্তাপ আরও বাড়াবে বলেই মনে করা হচ্ছে।