ভারতের কৃষি ক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতি ও জাতি গঠনের মূল ভিত্তি। তবে, দেশের ৮৬% এর বেশি কৃষক ছোট ও প্রান্তিক, যাদের গড় জমির পরিমাণ ১.১ হেক্টরেরও কম। এই ছোট কৃষকরা প্রায়শই বাজারে প্রতিযোগিতা, উন্নত প্রযুক্তির অভাব, ঋণের সীমিত প্রবেশাধিকার এবং মধ্যস্থতাকারীদের শোষণের মতো সমস্যার সম্মুখীন হন। এই সমস্যাগুলি মোকাবিলা করতে এবং কৃষকদের আয় বাড়াতে ভারত সরকার কৃষক উৎপাদক সংগঠন (FPO) গঠন ও প্রচারের উপর জোর দিচ্ছে। এফপিওগুলি ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের একত্রিত করে তাদের অর্থনৈতিক শক্তি এবং বাজারের সংযোগ বাড়ায়, যা তাদের জীবিকা ও আয়ের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই নিবন্ধে আমরা আলোচনা করব কীভাবে এফপিওগুলি ভারতের ছোট কৃষকদের ক্ষমতায়ন করছে এবং কৃষি খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে।
এফপিও কী এবং এর উদ্দেশ্য
কৃষক উৎপাদক সংগঠন (এফপিও) হল কৃষকদের দ্বারা গঠিত এবং পরিচালিত একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, যা কোম্পানি আইন, ২০১৩ বা সমবায় সমিতি আইনের অধীনে নিবন্ধিত হয়। এফপিওর মূল লক্ষ্য হল ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের একত্রিত করে তাদের উৎপাদন, বিপণন এবং ব্যবসায়িক ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এই সংগঠনগুলি কৃষকদের জন্য বীজ, সার, যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষণ, আর্থিক পরামর্শ এবং বাজার সংযোগের মতো সেবা প্রদান করে। এফপিওগুলি কৃষকদের সমষ্টিগত শক্তির মাধ্যমে মধ্যস্থতাকারীদের হাত থেকে মুক্তি দেয়, যার ফলে তারা তাদের উৎপাদিত পণ্যের জন্য ন্যায্য মূল্য পায়।
স্মল ফার্মার্স অ্যাগ্রিবিজনেস কনসোর্টিয়াম (এসএফএসি) এবং ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ফর অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট (নাবার্ড)-এর মতো সংস্থাগুলি এফপিও গঠন ও প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০২০ সালে ভারত সরকার “১০,০০০ কৃষক উৎপাদক সংগঠন গঠন ও প্রচার” স্কিম চালু করে, যার লক্ষ্য ২০২৭-২৮ সালের মধ্যে ১০,০০০ নতুন এফপিও গঠন করা। এই স্কিমের জন্য ৬,৮৬৫ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে।

ছোট কৃষকদের জন্য এফপিওর সুবিধা
এফপিওগুলি ছোট কৃষকদের জন্য একাধিক সুবিধা প্রদান করে, যা তাদের আয় এবং জীবিকার মান উন্নত করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুবিধাগুলি হল:
- বাজারে প্রবেশাধিকার এবং ন্যায্য মূল্য: এফপিওগুলি কৃষকদের সরাসরি বাজারে পৌঁছাতে সাহায্য করে, যার ফলে মধ্যস্থতাকারীদের শোষণ কমে। উদাহরণস্বরূপ, গুজরাট, মহারাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রদেশের এফপিওগুলি তাদের সদস্যদের জন্য উচ্চ মূল্যে ফসল বিক্রি করতে সফল হয়েছে।
- সমষ্টিগত দর কষাকষি: এফপিওর মাধ্যমে কৃষকরা সমষ্টিগতভাবে ইনপুট (বীজ, সার, কীটনাশক) ক্রয় এবং ফসল বিক্রির জন্য বড় ক্রেতাদের সঙ্গে দর কষাকষি করতে পারে। এটি খরচ কমায় এবং আয় বাড়ায়।
- অর্থনৈতিক স্কেলের সুবিধা: ছোট কৃষকরা এককভাবে অর্থনৈতিক স্কেলের সুবিধা পায় না। এফপিওগুলি সমষ্টিগত উৎপাদন ও বিপণনের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করে। উদাহরণস্বরূপ, এফপিওগুলি যন্ত্রপাতি ক্রয় বা ভাড়া নেওয়ার জন্য ঋণ সংগ্রহ করতে পারে।
- প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা: এফপিওগুলি সদস্যদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং প্রযুক্তিগত পরামর্শ প্রদান করে, যা ফসলের উৎপাদনশীলতা এবং গুণমান বাড়ায়। ক্লাস্টার-ভিত্তিক ব্যবসায়িক সংগঠন (সিবিবিও) এই প্রশিক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- আর্থিক সহায়তা: এফপিওগুলি নাবার্ড এবং এসএফএসি-র মাধ্যমে ঋণ ও অনুদানের সুবিধা পায়। উদাহরণস্বরূপ, এফপিওগুলি ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ম্যাচিং ইকুইটি অনুদান এবং ১০০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণের জন্য ৮৫% ক্রেডিট গ্যারান্টি পায়।
- নারী কৃষকদের ক্ষমতায়ন: কিছু এফপিও নারী কৃষকদের জন্য বিশেষ সুযোগ প্রদান করে, যা লিঙ্গ সমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ায়।
ভারতে এফপিওর সাফল্যের উদাহরণ
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এফপিওগুলি সাফল্যের উদাহরণ স্থাপন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, বারাণসীর কাশী বিশ্বনাথ কৃষক উৎপাদক সংস্থা স্থানীয়ভাবে তৈরি আলু পাপড় তৈরি ও বাজারজাত করে হোলি উৎসবে বিক্রি করেছে, যা স্থানীয় কৃষকদের আয় বাড়িয়েছে। গুজরাটের বানাসকান্থা অ্যাগ্রো প্রোডিউসার কোম্পানি ডালিম উৎপাদকদের জন্য বাজার সংযোগ স্থাপন করেছে, যা তাদের লাভ বাড়িয়েছে। মহারাষ্ট্র এবং রাজস্থানের এফপিওগুলিও তাদের সদস্যদের জন্য উচ্চ মূল্যে ফসল বিক্রির ক্ষেত্রে সফল হয়েছে।
এছাড়া, অসমে এফপিওগুলি কৃষকদের আয় বাড়াতে এবং অর্থনৈতিক স্কেলের সুবিধা প্রদানে দারুণ কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ১,৬০০ এফপিওকে ওএনডিসি নেটওয়ার্কে যুক্ত করেছেন, যা কৃষকদের সরাসরি বাজারে প্রবেশাধিকার দিয়েছে।
চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
এফপিওগুলির সাফল্য সত্ত্বেও, বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
- আর্থিক সীমাবদ্ধতা: অনেক এফপিওর কাছে পর্যাপ্ত মূলধন এবং ঋণের প্রবেশাধিকার নেই। ব্যাঙ্কগুলিকে এফপিওদের জন্য কাঠামোগত ঋণ পণ্য তৈরি করতে হবে।
- প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব: এফপিওগুলিতে প্রশিক্ষিত ব্যবস্থাপক এবং প্রযুক্তিগত কর্মীদের অভাব রয়েছে। এই সমস্যা মোকাবিলায় সিবিবিও এবং এনজিওদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
- বাজার সংযোগের অভাব: কিছু এফপিও বাজারের তথ্য এবং সংযোগের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি সমাধানে ই-নাম, জিইএম এবং ওএনডিসি-র মতো প্ল্যাটফর্ম সাহায্য করছে।
- শাসন সমস্যা: সদস্যদের মধ্যে সমন্বয় এবং নেতৃত্বের অভাব কিছু এফপিওর ব্যর্থতার কারণ। এটি মোকাবিলায় নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং স্বচ্ছ শাসন ব্যবস্থা প্রয়োজন।
সরকারের উদ্যোগ
ভারত সরকার এফপিওগুলিকে শক্তিশালী করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। ২০১৮-১৯ সালের বাজেটে এফপিওদের জন্য পাঁচ বছরের কর ছাড় ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৯-২০ সালের বাজেটে ১০,০০০ নতুন এফপিও গঠনের পরিকল্পনা ঘোষিত হয়। এছাড়া, ‘ওয়ান ডিস্ট্রিক্ট ওয়ান প্রোডাক্ট’ স্কিমের মাধ্যমে এফপিওগুলি নির্দিষ্ট ফসলের উপর বিশেষায়িত ব্র্যান্ডিং এবং বিপণনের সুযোগ পাচ্ছে।
এফপিওগুলি ভারতের ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য একটি গেম-চেঞ্জার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এগুলি কৃষকদের সমষ্টিগত শক্তি, বাজার সংযোগ, এবং অর্থনৈতিক স্কেলের সুবিধা প্রদান করে তাদের আয় বাড়াচ্ছে। যদিও আর্থিক, প্রযুক্তিগত এবং শাসন সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সরকার, এসএফএসি, নাবার্ড এবং অন্যান্য সংস্থার সমর্থনে এফপিওগুলি ভারতীয় কৃষি খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে। বর্তমানে দেশে ২৪,১৮৩টি এফপিও নিবন্ধিত রয়েছে, যার মধ্যে ২৩,৩৫৪টি সক্রিয়। ভবিষ্যতে আরও এফপিও গঠন এবং তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভারতের কৃষকরা তাদের আয় দ্বিগুণ করার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।