সিঁদুরে মেঘ! চলতিবর্ষে কলকাতার আইটি কোম্পানিগুলিতে নিয়োগ বন্ধ?

কলকাতা (Kolkata) পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী এবং ভারতের অন্যতম প্রধান আইটি হাব, গত কয়েক বছরে প্রযুক্তি খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। সেক্টর ৫ এবং নিউ টাউনের মতো…

Kolkata IT Companies Face Hiring Freeze in 2025: Employee Insights

কলকাতা (Kolkata) পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী এবং ভারতের অন্যতম প্রধান আইটি হাব, গত কয়েক বছরে প্রযুক্তি খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। সেক্টর ৫ এবং নিউ টাউনের মতো এলাকায় আইবিএম, ডেলয়েট, জেনপ্যাক্ট, এবং স্যাপের মতো বৈশ্বিক আইটি জায়ান্টদের উপস্থিতি কলকাতাকে ‘পূর্বের সিলিকন ভ্যালি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তবে, ২০২৫ সালে এই শহরের আইটি শিল্পে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশ্ববাজারের অনিশ্চয়তা এবং প্রযুক্তি শিল্পে ক্রমবর্ধমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) প্রভাবের কারণে অনেক কোম্পানি নিয়োগ বন্ধ (হায়ারিং ফ্রিজ) ঘোষণা করেছে। এই প্রেক্ষাপটে কলকাতার আইটি কর্মচারীদের মধ্যে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।

২০২৫ সালে কলকাতার আইটি শিল্পে নিয়োগের প্রবণতা
গুগল, মেটা, এবং আমাজনের মতো বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি জায়ান্টরা ২০২৫ সালে বাজারের অস্থিরতার কারণে নিয়োগ স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে। এই প্রবণতা কলকাতার আইটি শিল্পেও প্রভাব ফেলছে। সেক্টর ৫-এ অবস্থিত কিছু শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি, যেমন অ্যাকসেনচার এবং ডেলয়েট, তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সতর্কতা অবলম্বন করছে। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক আইটি শিল্পে এআই-কেন্দ্রিক ভূমিকার উপর ক্রমবর্ধমান জোর দেওয়া হচ্ছে, যা মানবসম্পদ সম্প্রসারণের পরিবর্তে স্বয়ংক্রিয়তার দিকে ঝুঁকছে। এই পরিবর্তন কলকাতার আইটি কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে ইন্টার্ন এবং মধ্য-স্তরের পেশাদারদের মধ্যে।

   

কলকাতার আইটি শিল্পে বর্তমানে প্রায় ২,৬০,০০০-এর বেশি কর্মী নিযুক্ত রয়েছেন৷ গত সাত বছরে ১,৫০০-এর বেশি আইটি সংস্থা এই শহরে তাদের কার্যক্রম প্রসারিত করেছে। তবে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপ এবং এআই-এর উত্থানের ফলে নিয়োগের গতি কমে গেছে। কিছু কোম্পানি, যেমন ভায়রাজু ল্যাবস এবং উইভার্স ওয়েব, এখনও ফ্রেশারদের জন্য সুযোগ প্রদান করছে, তবে এই পদগুলির জন্য ২৪ মাসের বন্ড এবং কঠোর প্রশিক্ষণের শর্ত রয়েছে।

Kolkata IT Companies Face Hiring Freeze in 2025
Kolkata IT Companies Face Hiring Freeze in 2025

কর্মচারীদের মতামত: উদ্বেগ এবং প্রত্যাশা
কলকাতার আইটি কর্মচারীদের মধ্যে এই হায়ারিং ফ্রিজ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেক্টর ৫-এ একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মরত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রাহুল দাস (ছদ্মনাম) বলেন, “গত বছরের তুলনায় এই বছর প্রমোশন এবং নতুন প্রকল্পে নিয়োগের সুযোগ কমে গেছে। এআই টুলের ব্যবহার বাড়ছে, তাই আমাদের নতুন দক্ষতা শিখতে হচ্ছে।” তিনি আরও জানান, অনেক কোম্পানি এখন ডেটা সায়েন্স, মেশিন লার্নিং এবং সাইবারসিকিউরিটির মতো ক্ষেত্রে দক্ষ কর্মীদের উপর বেশি জোর দিচ্ছে।

অন্যদিকে, নিউ টাউনে একটি স্টার্টআপে কর্মরত প্রিয়াঙ্কা সেন (ছদ্মনাম) বলেন, “হায়ারিং ফ্রিজের কারণে ফ্রেশারদের জন্য সুযোগ কমে গেছে। তবে, কিছু কোম্পানি এখনও ওয়েব ডেভেলপমেন্ট এবং ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মতো ক্ষেত্রে নিয়োগ করছে। আমি মনে করি, এখন দক্ষতা বাড়ানোর সময়।” তিনি ইন্টার্নশালার মতো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়নের কোর্সে অংশ নিচ্ছেন, যা তাকে ডেটা সায়েন্সে দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করছে।

কিছু কর্মচারী মনে করেন যে এই হায়ারিং ফ্রিজ অস্থায়ী। সল্ট লেকের একটি আইটি ফার্মের এইচআর ম্যানেজার অমিত মুখার্জি (ছদ্মনাম) বলেন, “বৈশ্বিক বাজারের অস্থিরতার কারণে কোম্পানিগুলি সতর্ক হয়ে গেছে। তবে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগ, যেমন বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালি হাব এবং ডব্লিউবিআইটিইএস, আইটি শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। আমরা আশা করছি, ২০২৬ সালের মধ্যে পরিস্থিতি উন্নত হবে।”

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমিকা
পশ্চিমবঙ্গ সরকার কলকাতার আইটি শিল্পের প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। ওয়েস্ট বেঙ্গল ইলেকট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (ডব্লিউইবিইএল) এবং স্টার্টআপ বেঙ্গলের মতো উদ্যোগ নতুন আইটি কোম্পানি আকর্ষণে সহায়ক হয়েছে। এছাড়া, কর সুবিধা এবং অবকাঠামোগত সহায়তা কলকাতাকে আইটি বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলেছে। বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালি হাবের মতো প্রকল্পগুলি স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকে শক্তিশালী করছে।

Advertisements

তবে, বর্তমান হায়ারিং ফ্রিজের কারণে কিছু চ্যালেঞ্জও দেখা দিয়েছে। সেক্টর ৫-এর মতো এলাকায় অফিস স্পেসের চাহিদা কিছুটা কমেছে, এবং নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ সীমিত হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে সরকার এবং বেসরকারি কোম্পানিগুলির মধ্যে আরও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার প্রয়োজন।

কর্মচারীদের জন্য পরামর্শ
কলকাতার আইটি কর্মচারীদের জন্য এই সময়টি দক্ষতা উন্নয়নের একটি সুযোগ। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, কর্মীরা এআই, ডেটা অ্যানালিটিক্স, এবং সাইবারসিকিউরিটির মতো ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করুন। ইন্টার্নশালার মতো প্ল্যাটফর্মে ডেটা সায়েন্স এবং মেশিন লার্নিংয়ের কোর্সগুলি ফ্রেশারদের জন্য সুযোগ তৈরি করছে। এছাড়া, ফ্রিল্যান্সিং এবং রিমোট জবের চাহিদা বাড়ছে, যা কর্মীদের জন্য বিকল্প আয়ের উৎস হতে পারে।

কিছু কোম্পানি, যেমন সোর্সডেস্ক এবং কর্মিক সলিউশনস, এখনও ওয়েব ডেভেলপমেন্ট এবং কনভার্সেশনাল এআই-এর মতো ক্ষেত্রে নিয়োগ করছে। এই কোম্পানিগুলি তাদের কর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং স্থিতিশীল কাজের পরিবেশ প্রদান করছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
কলকাতার আইটি শিল্প এখনও প্রতিশ্রুতিশীল। ইনফোসিস, উইপ্রো, এবং এলটিআইমাইন্ডট্রি-র মতো কোম্পানিগুলি ২০২৫ সালে নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের পরিকল্পনা করছে, যা নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। তবে, বর্তমান হায়ারিং ফ্রিজের কারণে ফ্রেশার এবং মধ্য-স্তরের কর্মীদের জন্য প্রতিযোগিতা বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যারা এআই এবং ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের দক্ষতা অর্জন করবেন, তারাই ভবিষ্যতে এই শিল্পে এগিয়ে থাকবেন।

২০২৫ সালে কলকাতার আইটি শিল্পে হায়ারিং ফ্রিজ একটি অস্থায়ী চ্যালেঞ্জ হলেও, এটি কর্মীদের জন্য নতুন দক্ষতা অর্জনের সুযোগ তৈরি করেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সক্রিয় উদ্যোগ এবং কোম্পানিগুলির কৌশলগত পরিকল্পনা কলকাতাকে আইটি হাব হিসেবে আরও শক্তিশালী করবে। কর্মচারীদের উচিত বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নতুন প্রযুক্তি শেখা এবং নিজেদের প্রতিযোগিতামূলক রাখা। এই পরিবর্তনের সময়ে যারা দ্রুত অভিযোজন করতে পারবেন, তারাই কলকাতার আইটি শিল্পের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবেন।